সংস্কৃতি, উৎসব, উৎসব পালন কে না ভালোবাসে? মানুষ বা যেকোন প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন; তেমনই মনেরও প্রয়োজন রয়েছে সুখ, আনন্দ ও পরিতৃপ্তির। আর এ চাহিদা পূরণ করে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কৃতকর্ম এবং সামাজিক রীতিনীতি। পৃথিবী থেকে চমৎকৃত হওয়ার মত সংস্কৃতি লালন ও পালনকারীদের বাছাই করতে হলে বোধকরি আদিবাসীদের নামই সর্ব প্রথমে আসা-ই অধিক যুক্তিযুক্ত। এরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ জাতি স্বপ্রণোদিতভাবে এবং আনন্দের সাথে বিভিন্ন সময় নিজস্ব উৎসবসমূহ পালন করে থাকে। গারো আদি ধর্মের নাম, সাংসারেক। প্রাচীন ব্যাবিলন, গীস, মিশর, চীন, পারস্য, রোমানদের মত গারোরাও সূর্যদেবতার পুজা করতো। গারোদের এ সূর্যদেবতার নাম ‘মিসি সালজং’; যার সন্মানার্থে ‘ওয়ানগালা’উৎসব পালিত হয়।

গারোদের উৎসবসমূহ সবগুলোই ঝুমচাষ কেন্দ্রিক। তাই চাষাবাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেবতাদের তুষ্টির জন্য, চাহিদামাফিক রোদ, বৃষ্টি, বায়ু এবং পোকামাকড়ের রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই উৎসবগুলো পালিত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একমাত্র ওয়ানগালা উৎসবই হচ্ছে আনন্দের; অর্থাৎ ঘরে ফসল তোলার পরই এই উৎসব পালন করা হয়। এটি একটি নৈবেদ্যোৎসব ও নবান্ন উৎসব। এই দিনে গ্রামের সকলেই সং নকমার বাড়িতে একত্র হয়ে গরু, শুকড়, মোরক দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। এ উৎসবের সময়কাল ৩ থেকে এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। তাই গ্রামের সকলেই সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে চু-খাজি খেয়ে নাচগানের মধ্য দিয়ে আমোদ করে থাকে। অতএব, বলা যায় গারদের উৎসবগুলোর মধ্যে ওয়ানগালাই বড় উৎসব। এসময়ে যুবকযুবতীদের জন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের কাজও চলতে থাকে।

গারোদের প্রধান উৎসবসমূহ যেমন- ১) দেন.বিলসিয়া, ২) আসিরকা, ৩) আগালমাকা, ৪) রংচুগাল্লা, ৫) জামেগাপ্পা আহাওয়া, ৬) ওয়ানগালা, ৭) দ.থাত্তা বা নকনি মিদ্দিনা হন্না, ৮) খ্রংনা দথাত্তা ইত্যাদি।

এটি গারোদের সবচেয়ে বড় উৎসব। শাব্দিক অর্থে ওয়ান্না মানে নৈবেদ্য এবং গালা বা গাল্লার মানে ফেলা। গারো ভাষায় যে কোন শব্দের রূপক ব্যবহার অত্যাধিক। তেমনি এখানেও গালা বা রূপক অর্থে কারোর উদ্দেশ্যে দেওয়া বুঝায়। যেমন, গারোরা মৃত ব্যক্তির স্মরণে কোন খাদ্য চিন্না বা দিলে ঘরের এক কোনে রেখে দিলে বা ফেলে দিলেই হয়। তেমনি কোন বস্তু দিলেও মৃতের কবরের কাছে রেখে দিলেই চলে। ওয়ানগালাতেও গালা শব্দটি উতসর্গ হিসাবে বলা হয়।

বহুদেবত্ববাদে বিশ্বাসী গারোদের সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরজুড়ে আছে উল্লিখিত দেব-দেবীকে নিবেদিত কৃত্য। সব কৃত্যের সমাচারই তাদের জীবন ও সংস্কৃতি। গারোদের আদি ধর্ম বহু-দেবতা ভিত্তিক। এই ধর্মে সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, বজ্র, বৃষ্টি প্রভৃতির পূজার বিধান রয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি গারোদের কৃষিবর্ষের সর্বশেষ, সর্বপ্রধান এবং সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান ও আনন্দোৎসব হচ্ছে ওয়ানগালা। ওয়ানগালা শুধু ধর্মের বিষয় নয়, গারোদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসাবেও এই ওয়ানগালাই প্রধান।

এতক্ষণ গারোদের বিভিন্ন উৎসব ও ওয়ানগালা নিয়ে কিছু ধারণা বা পাঠ দেয়ার চেষ্টা করলাম। ফেব্রুয়ারী মাসে গারোদের ওয়ানগালা উৎসব পালনের হেতু, অসময়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পালন করে কি পাঠ দিতে চান তা আমার জানা নেই; তবে বিষয়টি ‘জেফিরাজ দোলন কুবি’র মতোন সবার কৌতুহল জাগতেই পারে !

আমরা সকলে জানি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তামাশা, নাট্য বা রঙ্গমঞ্চসহ আরও কতকিছু হতে পারে। কিন্ত খোদ একটি জাতিসত্তার ঐতিহ্যবাহী প্রধান উৎসব ওয়ানগালকে নিয়ে যাচ্ছেতাই, অর্থাৎ যেকোন সময় করা যেতে পারে, এমন দু :সাহসিকতা দেখিয়ে এ কোন পথ দেখালেন, কি বার্তা দিলেন নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক মহোদয় ?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি জাগে- ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আমাদের অহংকার ও গৌরবের; তেমনি গারো ভাষা, তথা গারো কৃষ্টি, সংস্কৃতি অধিকার প্রশ্নে বায়ান্নে তরুণেরা রক্ত দিলেও সেখানে বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার চেতনাও ছিল নিহিত, যা আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। যদি তাই আমরা বিশ্বাস করি তাহলে একটি জাতিসত্তার কৃষ্টি সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ঐতিহ্যগত বিষয়ে ব্যতিক্রম কিছু উপস্থাপন এবং উৎসব পালনের অধিকার অর্থাৎ বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক মহোদয়কে কে দিয়েছে?

দু:খজনক হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর এবং স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পরও স্বাধীন দেশে প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠির ভাষার বেহাল দশা দেখতে হচ্ছে। বাংলা ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠির ভাষা, ব্যবহার ও মর্যাদা রক্ষায় আমাদের নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বহু আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি চোখের পলকে হারিয়ে যাচ্ছে। সে জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার কী হাল হবে, কৃষ্টি সংস্কৃতির হাল কি হবে সেদিকে আমাদের নজর নেই বললেই চলে। মোদ্দা কথা, সেসব জাতিগোষ্ঠীর কৃষ্টি সংস্কৃতি দেখভাল করার মতোন কেউ নেই, পরিবেশ আজও তৈরি হয়নি।

বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি আদিবাসী জনগোষ্ঠির সংস্কৃতির ধারক, বাহক এবং অভিভাবক হয়ে ওয়ানগালা উৎসব পালনে যে উদ্যেগ গ্রহণ করেছে এবং ভিন্ন একটি সময়ে পালনের বিষয়টি খুবই হতাশাজনক, এবং দু:খজনক। অসময়ে গারো উৎসব ওয়ানগালা পালন করে এ প্রজম্মের কাছে ভুল বার্তা দেয় তা সোশ্যাল মিডিয়াতে শোরগোল পড়ে যাবে, পড়বে বিষয়টি আমার চেয়েও আপনাদের ভালো জানার কথা।

আমাদের আফসোস হয়, কোথায় বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠির হিতকারী, ভাষা সংস্কৃতি চর্চার ঘরানা তৈরি করবে, বরং তা না করে গারো সংস্কৃতি তথা ওয়ানগালা উৎসব অসময়ে পালন করে, চর্চার নামে ভুল বার্তা দেয়ার চেষ্টা করলেন বলে আমার মতোন অনেকেরই সহজে বোধগম্য হয়েছে।

আপনি বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি আসলে আপনার কাজ কি ? আপনার কাজ হলো- এলাকার আদিবাসী জনগোষ্ঠির ভাষা চর্চা, ভাষা শিক্ষা, তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি চর্চার সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া। বিলুপ্ত প্রায় ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। প্রতিকারের সুব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ সরকার দেশে মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণার জন্য ইনস্টিটিউট ও নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে আপনাদের মাধ্যমে। আপনাদের দূরদর্শিতার অভাবে একটি জাতিসত্তার কৃষ্টি সংস্কৃতি মিস গাইডেড, মিস কনসেপ্ট তৈরি হবে কিংবা হারিয়ে যাবে তা কখনো হতে পারে না।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে প্রত্যেক প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠির ভাষা সংস্কৃতি প্রাণ আবার ফিরে পাবে সেটা আমাদের সবার প্রত্যাশা। এ দেশের মানুষ নিজের ভাষার অধিকার ফিরে পাবার জন্য প্রাণ দিল, সেই দেশেই আরেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারবে না, তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি বিকৃতি, বিকলাঙ্গ করে ফেলবেন সেটি কী করে হয়? গদিতে বসে বসে যদি তাই করতে হয়, হতে থাকে; গদিতে বসে এমনসব ভুল কাজই যদি করে বসেন তাহলে এটি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার এবং গোটা রাষ্ট্রের জন্যও ব্যর্থতা।

এহেন আমার শেষ কথা হলো, খুঁশিতে আহল্লাদে আরাম আয়াসে গদিতে বসলেই হবে না, গদির ওপর নিজের ওজনও থাকতে হবে। সে এলাকার জনগোষ্ঠির জন্যে আদিবাসী বান্ধব কর্মকাণ্ডও আপনাকে দেখভাল করতে হবে। টেকসই সংস্কৃতি চর্চা ও পালনের সুব্যবস্থা করতে হবে সেটিই সবার প্রত্যাশা।