এ সময়ে এটি জনপ্রিয় শুধু  যে পেশা তা নয়; এ বিষয়ে বিভিন্ন ইউনিভার্সিতে একটি সম্মানজনক ডিগ্রি অর্জনের ফ্যাকাল্টি বা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে আমার ধারণা। নরসুন্দর বা নাপিত বিষয়টি কিছুটা হাস্যকর, অবহেলিত বিষয় মনে হলেও জ্ঞানের খোরাকতো বটেই; অন্যদিকে এটি সহজ এবং কম অর্থ ইনভেস্ট করে অনুন্নত দেশেও উন্নত সেবা নিশ্চিত করে একটি লাভজনক ব্যবসা হতে পারে বৈকি!

নাপিত বা নরসুন্দর। নরসুন্দর বা চুল দাড়ি কাটার নাপিত বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা মেলে। কিন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পথে ঘাটেও এমন ভাসমান নরসুন্দর দেখা মিলবে ভাবনাটি আপনার কাছে কেমন তা জানি না; তবে কেন জানি আমার কাছে অবাস্তব মনে হতো। এমন দৃশ্য দেখলে আপনিও প্রতিবেদকের মতোন ভেবাচেকা খেয়ে যেতেন বোধয়, নয় কি!

এমন তিলোতমা নগরীতে চুল দাড়ি কাটার চেয়ার, টুল বা বসার কোন ব্যবস্থা নেই তা কি করে হয়! তাও আবার রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে চুল দাড়ি কাটার ভাসমান কি অভিনব ব্যবসা ভাবতে পারেন ! জাস্ট রাস্তায় পথচারীদের নিরাপত্তায় বসানো কনক্রিটের পিলারে কাস্টমারকে দিব্যি বসিয়ে এমন রমরমা ব্যবসা। আবারও বলছি, ইউরোপের মতোন দেশেও ‍চুল দাড়ি কাটার ভাসমান ব্যবসা কিছু একটা কি আপনি ভাবতে পারেন! আমি আবার বলছি, আমার ভাবনায় আসেনি এবং এখনো আসে না। বাংলাদেশের গ্রাম্য হাট বাজারেরও চেয়ার না হলেও অন্তত টুল বা পিড়িতে বসিয়ে এমন ব্যবসা দৃশ্যের দেখা মেলে। মেয়েরা চুল কাটার জন্যে লাইন ধরে বসে থাকতেও দেখা যায়। সহসায় প্রশ্ন আসে কিন্ত কেন ?

ইউরোপে খুব সাধারণ মানের চুল দাড়ি কাটাতে পুরুষদের মিনিমাম বারো ইউরো গুনতে হবে, যা বাংলাদেশি টাকায় পনেরশত টাকা। মেয়েদের ক্ষেত্রে এর দাবল চার্জ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। সেটি নির্ভর করছে আপনি কোন এলাকায় সেবাটি নিতে যাচ্ছেন। আর তাছাড়া অন্যান্য পরিসেবার জন্য আলাদা আলাদা করে চার্জ দিতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব সেবা নিতে গেলে আগে থেকে এ্যাপয়মেন্ট নিতে হবে। পাঠক হয়তো ভাবতে পারে মানুষের নজর কাড়তে এমন প্রতিবেদন। আবার আপনি ধরে নিতে পারেন প্রতিবেদকের অন্তর দৃষ্টিশক্তির ঘাটতি আছে। এমন ভাবাটাও অস্বাভাবিক, অমূলক কিছু নয় !

প্যারিসে রাস্তার ওপর ভাসমান সেলুন, নরসুন্দর চুল কাটছে; ছবি: আ.বিমা টাইমস, প্যারিস ম্যারে  

এমন পেশায় জড়িত ব্যক্তির ওপর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বা পরিসেবার বিষয়টিও অত্যন্ত উঁচু মানের তা কিন্ত নয়। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে নরসুন্দরদের সামাজিক অবস্থানও মিশ্র ধরনের। এ পেশার প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব নেতিবাচক হলেও নাপিত ছাড়া কোন শ্রেণীপেশার চলতে পারে না। যে পেশাই কাজ করুক; বাস্তবতা হলো পেশাতো পেশা-ই। নাপিত বা নরসুন্দর বলতে এমন এক শ্রেণীর পেশাজীবিদের বুঝায় যারা মানুষের চুল ছাঁটেন এবং দাড়ি গোঁফ কামিয়ে জীবন ধারণ করেন। এক কথায় বলতে গেলে চুল দাড়ি ছাঁটা বা কাটা তার মূল এবং প্রধান পেশা।

উন্নত দেশেও সব পেশার মানুষের দেখা মেলে। তবে কাজের ধরণ এক হলেও এর ব্যবস্থাপনা ভিন্ন এবং উন্নত হবে এটা উন্নয়নশীল দেশের কমন ধারণা। ঠিক এমন কিছু বাস্তব চিত্র নিয়ে আ.বিমা টাইমস ভিন্নরকম প্রতিবেদন ‘প্যারিসের পথেঘাটে’ শিরোনামে প্রতিবেদন তৈরি করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই।

এহেন প্রশ্ন জাগে মনে, নাপিত বা নরসুন্দর পেশায় কোন প্রেণীর বা কোন জাতিগোষ্ঠিরা জড়িত। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে নাপিত ছিল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান স্বরূপ। আগেকার দিনে হিন্দু সস্প্রদায়ের বিয়ে ও জন্ম উৎসবে নাপিতরা কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। মুসলিম পরিবারবর্গও নবাগত শিশুর মাথা ন্যাড়া করার জন্যে নরসুন্দরের দ্বারস্থ হতো। হিন্দু পরিবারে কারও মা অথবা বাবা মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর নাপিত তার ছেলেদের মাথা ন্যাড়া করে দেয়। তবে খুব জরুরি প্রয়োজনে এবং বয়স্কদের চুল দাড়ি কামাতে অনুরোধে অনেক নাপিত বাড়িতে গিয়েও চুল ছেঁটে দেন।

নরসুন্দর বিষয়ক তথ্য উপাত্ত ঘেটে আরও কিছুটা অবাক করার তথ্য পাওয়া গেল যে, পৃথিবীর প্রথম পাস করা শল্যবিদ বা সার্জনদের মধ্যে অনেকেই প্রথম জীবনে পেশায় নাপিত ছিলেন। ইংল্যান্ডে এখনও ডাক্তারদের ‘ডক্টর’ এবং সার্জনদের ‘মিস্টার’ নাপিত বলার রেওয়াজ আছে। সার্জনদের ‘ডক্টর’ বললে ডক্টররা নাকি অপমানিত বোধ করেন ! মধ্যযুগে ইউরোপের নাপিতেরা দলে দলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শল্যবিদ্যায় ডিগ্রি নিতে। এই নাপিতেরা যখন পেশাদার সার্জন ছিলেন না, তখন রোগীর শরীরে তাঁরা ইচ্ছেমতো ক্ষুর চালাতেন।

আগেকার দিনে কিংবা এখনো গ্রামের বাজারে বা শহরের অলিতে গলিতে নাপিতদের নির্দিষ্ট দোকান আছে। সেখানে লোকেরা তাদের চুল, দাঁড়ি কাটা, ছাঁটা, নখ কাটা এবং ছোটখাট কাটাছেঁড়ার কাজ করায়। এসব সেবা প্রদানের মাধ্যমেই নাপিত উপার্জন করে থাকে। এই উপার্জন অর্থ হতে পারে, আবার কোন দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। আগেকার দিনে নাপিতদেরকে কাজের বিনিময়ে সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হতো। এই বিনিময় প্রথার নাম ছিল যজমানি ব্যবস্থা। গ্রামের লোকজন সারা বৎসরের সেবার বিনিময়ে, নাপিতদের ফসলের মৌসুমে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য দিত। চালাকিপনা, রসিকতা, আড্ডাবাজি ও গল্প বলায় নাপিতদের বিশেষ দক্ষতা ছিল। এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে এবং এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে তথ্য আদানপ্রদান হতো নাপিতদের মাধ্যমে। এছাড়া শিশুর জন্ম-সংবাদের বাহক হিসেবে তারা কাজ করত। আর নবজাতক ছেলে শিশু হলে সে খবর সরবরাহ করে উভয় পক্ষ থেকে তারা উপহার পেত।

প্রতিবেদন লেখার শুরুতেই বলেছিলাম যে, নরসুন্দরদের সামাজিক অবস্থানও মিশ্র ধরনের। কেউ কেউ মনে করেন, নাপিত এসেছে ক্ষত্রিয় পিতা এবং শূদ্র মাতার পরিবার থেকে। অনেকের ধারণা নাপিতের উৎপত্তি দেবতা শিব থেকে, যিনি তাঁর স্ত্রীর নখ কেটেছিলেন। নাপিতরা কতিপয় অনুসস্প্রদায়ে বিভক্ত, যথা আনারপুরিয়া, বামানবেন, বরেন্দ্র, রাঢ়ী, মাহমুদাবাজ, সপ্তগ্রাম, সাতঘরিয়া, খোট্টা ইত্যাদি। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, অনেক গুল নিন্মসম্প্রদায়ের কাছে অস্পৃশ্যী হলেও নাপিতের হাতে পানি তারা পান করতেন।  অধিকাংশ নাপিতই বৈষ্ণব। ধর্মীয় কাজে তারা ব্রাহ্মণদের পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে। তাদের মৃতদেহ আগুনে পোড়ানো হয়। মৃত্যুর একত্রিশ দিন পর শাস্ত্রমতে তাদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। খাবারদাবার পরিবেশনে তারা হিন্দুশাস্ত্র মেনে চলে। বৈষ্ণব নাপিত মাংস খায় না, নিরামিষভোজি হলেও এরা কিন্তু মাছ খায়।

দিনকে দিন এ পেশায় এবং পেশাদারিত্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ শহুরে নাপিতদের অবস্থান ও চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এসব পরিসেবা বলতে, বলতে গেলে রাজকীয় ব্যাপারসেপার হয়ে দাড়িয়েছে। এখানে নারীপুরুষ বা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য ঘরোয়া সেলুন আছে। রয়েছে উন্নতমানের বসার সিট এবং সেবার যন্ত্রপাতিগুলো আধুনিকসহ পেশাদার নাপিত বা সাঁজশিল্পী। সাধারণত মেয়েদের জন্য আলাদা নরসুন্দর থাকে। মেয়েদের নরসুন্দরও মেয়ে হয় এবং তারা সাধারণত পার্লারে তাদের চুল কাটা, অবাঞ্ছিত লোম উত্তোলন সহ রূপ চর্চার যাবতীয় কাজ করে থাকে। শহুরে নাপিতরা চুল কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দক্ষতার সাথে সেলুনে কাজ করে। গ্রামের নাপিতদের চেয়ে শহুরে নরসুন্দরদের উপার্জন অনেক বেশি। শহুরে নাপিত চুলকাটা ও কেশসজ্জা এবং কখনও বা মাথা মালিশ করা ছাড়াও অন্য অনেক সেবা দিয়ে থাকেন।শহুরে পার্লারে বা সেলুনে এমন সেবার পাশাপাশি অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। তবে গ্রামের নাপিতরা কেশবিন্যাস বা মালিশের কাজ প্রায় করে না বললেই চলে। সম্প্রতি মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও নরসুন্দর হতে দেখা যায়।

এ সময়ে এটি জনপ্রিয় একটি শুধু যে পেশা তা নয়; এ বিষয়ে বিভিন্ন ইউনিভার্সিতে একটি সম্মানজনক ডিগ্রি অর্জনের ফ্যাকাল্টি বা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে আমার ধারণা। নরসুন্দর বা নাপিত বিষয়টি কিছুটা হাস্যকর, অবহেলিত বিষয় মনে হলেও জ্ঞানের খোরাকতো বটেই; অন্যদিকে এটি সহজ এবং কম অর্থ ইনভেস্ট করে অনুন্নত দেশেও উন্নত সেবা নিশ্চিত করে একটি লাভজনক ব্যবসা হতে পারে বৈকি!

 

প্রাবন্ধিক

লুই সাংমা, প্যারিস।