গত ১৫ মার্চ ঘোষণা করা হয়েছে স্বাধীনতা পদক। মন্ত্রী পরিষদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ বছর ১০ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে এ বছর সমাজ সেবা/জন সেবায় যিনি পুরস্কার পেয়েছেন, সেই মনোনীত গারো আদিবাসী অরণ্য চিরানকে নিয়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে জোর আলোচনা। খোদ গারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে চলছে সমালোচনা আলোচনা। সবার একটিই জিজ্ঞাসা, কে এই অরণ্য চিরান?

আলোচিত অরণ্য চিরান সম্পর্কে জানার আগে, দেশে স্বাধীনতা পুরস্কার কিসে দেয় এবং কিভাবে মনোনীত হন, কোন কোন বিষয়ে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেয়া যাক-

স্বাধীনতা পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। সাধারণভাবে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ১০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের জারি করা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার সংক্রান্ত নির্দেশাবলি’ অনুযায়ী একাধিক ধাপে যাচাই-বাছাই করে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। ১৩ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। ক্ষেত্রগুলো হলো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা বা জনসেবা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জনপ্রশাসন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং সরকার নির্ধারিত অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে এই পুরস্কার দেওয়ার কথা। তবে পুরস্কারের সংখ্যা সাধারণভাবে কোনো বছরে ১০ এর বেশি হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা পোষণ করলে কোনো বছর এই পুরস্কারের সংখ্যা বা ক্ষেত্র কমবেশি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

এবার আপনি অরণ্য চিরানের নামটি যদি প্রথমবারের মতো শুনে থাকেন, তবে নোট করে জেনে রাখুন, তিনি নিজে সাম্প্রতিক সময়ের এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি ছাত্র জীবন থেকে সংগঠন করেন, ট্রাইভাল ওয়েলফেয়ারের এসোসিয়েশন ময়মনসিংহ শাখার এক্স জেনারেল সেক্রেটারী এবং সেন্ট্রালের, বর্তমানে তিনি সে সংগঠনের ময়মনসিংহ শাখার চেয়ারম্যান। এছাড়াও বিভিন্ন তথ্যে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়, তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কনভেনর। ব্যাক্তি জীবন বা পেশাদারিত্বে সারা নামক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মী। মোদ্দা কথা, মাত্র দুয়েকটি সংগঠনে সেবার বদৌলতে আরণ্য চিরানের ললাটে জুটেছে আজ জনসেবা শাখায় দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারটি। তাঁর বিষয়ে আরও কিছু তথ্য হলো, তিনি লেখালেখি করেন, তিনি আওমীলীগ রাজনীতির মতাদর্শী। এতো ফিরিস্তির পর অরণ্য চিরানের দেয়া জনসেবাটি কি ছিল, কিভাবে এবং কেন, কাদেরকে, কোন জনগোষ্ঠীকে দিয়েছিল, সংখ্যায় কত ছিল, কত বছর ইত্যাদির পরিসংখ্যান জানার তীব্র আকাঙ্খা রয়েই গেল।

আরেকটু জেনে রাখা ভালো, স্বাধীনতা পুরস্কারের প্রক্রিয়া কি – স্বাধীনতা পদকের জন্য তো একটা নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। এরপর যেকোনো স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা সরকারের যেকোনো সচিবের সেই আবেদনের পক্ষে সুপারিশ লাগে। এখন জনমনে প্রশ্ন জাগে, জানতে ইচ্ছে করে অরণ্য চিরানের জন্য সুপারিশ করেছিলেন কোন মন্ত্রণালয় এবং কোন সচিব, কিসের ভিত্তিতে সুপারিশ করেছেন !

আমারও ব্যক্তিগতভাবে জানতে ইচ্ছে করে,  স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় মর্যাদাবান একটি সম্মাননা একজন অচেনা সমাজসেবক পাওয়ায় কেন ক্ষুব্ধ হবেন না, কেন সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা সমালোচনা হবে না। হয়তো গুটি কয়েক ব্যক্তি অরণ্যকে চেনেন, কিন্ত তাঁর সেবার বিষয়ে অনেকেই পরিচিত/অবগত নন তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো একবার ভাবুনতো !

আমার বিশ্বাস গারো সমাজসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও অর্থাৎ সবার একই প্রশ্ন হতে পারে। আমার কথা হলো, স্বাধীনতা পদকের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মানে প্রশ্ন থাকবে কেন ?

রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে যদি প্রশ্ন থাকে, প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে; তাহলে কিভাবে আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে তাঁদের অভিনন্দন জানাবো! তাও আবার স্বাধীনতা পুরস্কারে। শুধু অরণ্য চিরান নয়, দেশের আনাচে কানাচে যদি সত্যিকার সমাজ সেবক থাকে তাহলে এতোদিন এঁরা কেন গোচরে আসেনি। আজকাল আমাজন জঙ্গলের খবর মিডিয়াতে আসে, ফোকাস হয় তাহলে অরণ্য চিরানের জনসেবার খবর কেন বাদ যাবে, নাকি ইচ্ছে করেই বাদ পড়েছে ! এমন হাজারো প্রশ্ন থেকেই গেল।

শেষ কথা হলো, আপনি যোগ্য হলে অবশ্যই রাজ পথের মালা পড়বেন। আমরাই আপনাকে রাজ পথের মালা পড়াবো। শ্রদ্ধার সঙ্গে অভিনন্দন জানাবো। কিন্ত পুরস্কার দিতে গিয়ে, স্বাধীনতার পুরস্কার পেতে আমাদের স্বাধীনতাকেই অসম্মান করছি কিনা সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। অন্যদিকে পুরস্কার পাওয়া/আবেদনের আগে নিজেকেও ভাবতে সে পুরস্কারের আমি যোগ্য কি না।

আর যদি কাউকে শুধু ভালোবেসে পুরস্কার দেয়, পুরস্কৃত করে, পুরস্কৃত করতে চায় সেটি ভাবার বিষয় নয় আমাদের।