পৃথিবীতে গান অপছন্দ করে এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল ! অর্থাৎ গান মানুষের আত্মার খোরাক। একটি গান নিমেষেই আপনার খারাপ মন ভালো করে দিতে পারে। আবার আপনার মনও খারাপ করে দেবার জন্যে ঐ একটি গানই যথেষ্ট।

একটি ভালো গান মানুষকে বিনোদিত করে। হাজার বছর ভালো গানকে মানুষ ধরে রাখে। সে গান বারংবার গায়, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে। বলতে গেলে এ গান এক প্রকার প্রাণ। যে প্রাণের টানে মানুষের প্রকৃত প্রাণটি আন্দোলিত হয়। একটি উৎকৃষ্ট মানের গান অর্থাৎ বাণীপ্রধান গান মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন পেতে বসে। বিশ্বের সব ভাষার মানুষই গানের ভেতরে অবগাহন করে। মানুষের আনন্দ ও সুখানুভূতিতে গান যেমন তৃপ্তিদায়ক, তেমনি দু :খ-কষ্ট বা ব্যথা-বেদনার নিরাময়ক।

কি কি বিষয়ে গান রচিত হতে পারে

যেকোন বিষয়ে গান হতে পারে। গানের কথায় যেমন থাকে মা-মাটি আর দেশ। তেমনি প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, বিচ্ছেদ বা বিরহ, জীবনবোধ, আধ্যাত্মবাদ, ধর্মবোধ, ভক্তি মূলক পল্লী, ভটিয়ালি, মারফতিসহ আরও অনেক বিষয়ে গান রচিত হতে পারে।

বাংলা বা অন্য গানের প্রভাব

গানের কথা যদি বলি, আধুনিক বাংলা গানে আমরা পঞ্চকবির প্রভারের বিষয়টি জানি। এই পঞ্চকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেন ও কাজী নজরুল ইসলামকেই অনুসরণ করে এখনকার গীতিকবিরা লিখে যাচ্ছেন। পঞ্চকবির সাথে লালন ও হাসান রাজা, ওয়েস্টার্ন প্রভাবও বাংলা গানে যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়।

গান তৈরিতে বাদ্য বাজনা এবং গাওয়ার রীতি-নীতি কলা-কৌশলও তৈরি করেছে মানুষ। ফলে এ গান সৃষ্টি এবং চর্চার ইতিহাস পুরোনো এটি স্পষ্ট। কিন্ত এক সময় গারো গান, গীতিকার, এবং গায়ক/গায়িকাদের পদাচরণা স্থবির অবস্থায় চলছিল। গারো গানের চর্চার ধারা প্রাচীন হলেও গারো গানের প্রভাব সম্পর্কে তেমন কোন গবেষণা বা তথ্য আমার গোচর হয় নি। এর মানে এই নয় যে গারো গানে কোন প্রভাব নেই। প্রভাব থাকতেও পারে এবং থাকে যা আমরা গবেষণা করে দেখি নি।

আমরা যা দেখছি, এ সংগীত যুগে যুগে এবং নানান সংগীত আয়োজনই পরিবর্তীত হচ্ছে। প্রযুক্তি আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে। সংগীত ভক্তদের মাঝেও অনেক পরিবর্তন ঘটছে। তারা এখন বাংলা গানে পাশ্চাত্যের প্রভাবকে কাছে টেনে নিচ্ছে। কিংবা হিন্দি, আরবি, ফার্সি অথবা ভিন্ন জাতির গান গেয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে শিল্পীরাও সেভাবেই গাইছেন।

গারো গায়ক এবং গীতিকার

আদিকাল থেকে গারোরাও সংগীত প্রিয় ছিল। ফলে নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র থেকে শুরু করে গারোরা নারী পুরুষ উভয়ই অলঙ্কার ব্যবহারের প্রচলনও ছিলো। তবে নারী ও পুরুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নক্সা ও আকারের অলঙ্কার তৈরী করা হতো। কালের আবর্তে গারোরা এসব অলঙ্কার স্বচোখে দেখাতো দূরের কথা, এদের নাম পর্যন্ত ভুলতে বসেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই হয়তো ভুলেও গেছে। নতুন গারো প্রজন্মদের এসব অলঙ্কারের নাম এবং ব্যবহার সম্পর্কে জানার আগ্রহ থাকা উচিত। পুস্তক ঘাটাঘাটির পাশাপাশি গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া জরুরি বিষয়।

এহেন কথা বলছিলাম গারো গায়ক এবং গীতিকার বিষয় নিয়ে। গারোদের মধ্যে সংগীত বোদ্ধা অদ্যাবধি চোখে পড়ে নি। যাদেরকে গারো গায়ক, গীতিকার হিসেবে জানি তাও হাতেগোনা কয়েকজন। যারা নীরবে নিভৃতিতে নিজেদের প্রয়োজনে একটু-আধটু গান-টান গেয়ে থাকেন, গান লিখে থাকেন। সংগীত বিষয়ে শিক্ষা সেতো মাত্র শুরু। যারাও শিক্ষা শেষ করেছে এদের মধ্যে গারো সংগীতে অবদান এখনো পড়েনি। গারো সংগীতকে উচ্চ ধারায়, অনন্য ধাপে উঠাতে আরও সময় লাগবে বৈকি! গারো গান নিয়ে প্রচুর এবং আরও গবেষণা প্রয়োজন।

তথ্যপ্রযুক্তির হওয়ায় নতুন গারো গায়কদের আনাগোনা দেখি। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলা গায়কী প্রভাব বেশি লক্ষণীয়। গারো বা আ.চিক গান গাওয়ার মতোন গায়কীপনা এদের মধ্যে খুব কম কোয়ালিটি রয়েছে। প্রথম যে দূর্বলতা লক্ষণীয় আর তা হলো গারো ভাষা। তাদের প্রবল আগ্রহ থাকলেও গারো ভাষা সঠিক চর্চা নেই বলে সহজে নিজস্ব গারো ভাষায় গান গাওয়া দূরহ কাজ। এদের সামনে কঠিন একটি চ্যালেঞ্জও বটে। ইতোমধ্যে দুয়েকজনের গাওয়া গারো সংগীত সোস্যাল মিডিয়াতে দেখে মেলে যা আমাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। অর্থাৎ এতো অল্প সময়ে গান বেঁধে বা বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দেয় যা আমাদের আরও ভাবিয়ে তোলে। যেখানে ভাষার উচ্চারণগত ভুল, সস্তায় মিউজিক নির্মাণসহ গানের নিয়মগুলো সঠিকভাবে অনুসৃত হয়নি। ফলে গান একটি বিনোদন কিংবা হৃদয়ঙ্গমের বিষয় তা পরিপূর্ণভাবে অনুপস্থিত। পাশাপাশি এমন একটি মানহীন গান শিল্পী, এবং মিউজিক নির্মাতাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে নীচে নামিয়ে দেয়।

এবার আসা যাক গারো গীতিকার নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ব্যক্তিগত অভিমত। কারণ সংগীত করা বা তৈরি একার কোন বিষয় নয়। গারো গীতিকার তেমন নেই বলেই চলে। ছোট বেলায় দুয়েকজনের নাম শুনেছি। তাদের গানও শুনেছি; এখনো মাঝেসাজে শুনলে সে গান আমাকে বেশ আন্দোলিত করে। এটা সত্য তাদের গানে আধুনিকতা ছিল না; তবে কিছু গানে মর্মার্থ অত্যন্ত গভীর ছিল। বিনোদনের আলাদা জায়গা তৈরি করেছিল।

বর্তমান সময়ে কিছু গারো গান সৃষ্টির যেমন সময় লাগে না, তেমনি মিডিয়াতে আসতেও সময় লাগে না। যদি এমন হয় এবার বুঝতেই পারছেন গারো গানে বারোটা বাজলো, নাকি তেরোটা বাজছে! এমন গানের কথা, কাব্যিক গাঁথুনিবা কেমন, মিউজিক কম্বিনেশান ইত্যাদি গানের একটি ইউনিক বিষয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েই যায়।

গারোহাব (GaroHub) এর উদ্দেশ্য লক্ষ্য

ইদানিংকালে কিছু তরুণ এবং কিছু অগ্রজ কবি ও গীতিকারদের দেখা মেলে যা হয়তোবা গারো গানকে অনন্য উচ্চতায় নিতে চেষ্টা করছে যা প্রশংসার দাবি রাখে। ব্যক্তি উদ্যোগে সংগীত এবং মিউজিক নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু গারো ব্যান্ড দলও তৈরি হয়েছে। কিছু গারো মিউজিক প্রডিউসার তৈরি করছে নান্দনিক এবং আধুনিক ধারার গান। গারোহাব মিডিয়া পরিবার এদেরই সহযোদ্ধা। বিশুদ্ধ গারো গান উপহার দেবার নির্মিত্তে গেল বছর আবির্ভূত হয় সোস্যাল মিডিয়া জগতে। ভিন্ন ধারার একটি রিয়েল গারো প্লাটফর্ম। অর্থাৎ গারোহাব এর তৈরি গারো গানে আপনি রিয়েল গারো প্লেভারটি পেতে পারেন।

আরও জরুরি বিষয় যা না বললেই নয়; সংগীত জগত বিশাল একটি বিষয়। ফলে গান বিষয়টি খাটো করে দেখার নয়। যে বা যারা গারো গানকে নিছক ফানি বা সহজ একটি বিষয় মনে করছে, সেটি আসলে বিনোদন নয়। বাংলা গানের ঐতিহ্য যেমন অনেক শক্তিশালী। তেমনি গারো গানের ঐতিহ্য রয়েছে এবং সেগুলোকে সচেতনতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে। গারো ভাষা, এবং শব্দ প্রয়োগে আরও যত্নবান হওয়া উচিত। গারোহাব মিডিয়া পরিবার গারো গানে যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে সে পথ ধরেই গান লিখে প্রকাশ করে যাচ্ছে। কিন্ত একটি লক্ষণীয় বিষয় যুগের চাহিদা, মানসিকতার পরিবর্তন বা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গানের বাণী পরিবর্তীত হচ্ছে। যা যুগে যুগে হয়েছে। কিন্তু গান নষ্ট হয়ে যাচেছ সেটি বলা যাবে না। গান শোনার মাধ্যম পরিবর্তিত হচ্ছে। ভালো গানের সাথে কিছু দুর্বল গানও হচ্ছে। এটি আগেও ছিল এখনো আছে। দুর্বল গানকে পরিহার করা আমাদের অভ্যাসে পরিনত করতে হবে। গারোহাব মিডিয়া পরিবার সে পথ ধরে হাটছে। আরও অনেক দুর হেটে যেতে চায়।

প্রবন্ধের শেষ কথা, বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির স্বর্ণযুগে অনেক ভালো ভালো গারো গান হচ্ছে কিন্তু তার স্থায়ীত্বকাল বেশী দিন হচ্ছে না। গারোরাও গান প্রিয় জাতি। যুগে যুগে গান মানুষকে আন্দোলিত করেছেন, মোহিত করেছে। গারোরাও এমন এক জাতি যেখানে বিয়ে বাড়ি থেকে শুরু করে সব কাজে এখনো গান ব্যবহার করে। শোক সভা ও প্রার্থনায়ও গান হয়। সব ধরনের গান আমাদের টানে। বলতে হবে গান অনেক শক্তিশালী বিষয়।

একটা সময় ছিল যখন বাড়ির পাশ দিয়ে হেটে গেলেও প্রকৃতির টানে আনমনা ভাব থেকে বেড়িয়ে আসতো গানের কথা। অনেক সময় অবচেতন মনে গেয়েও নিতো দুই তিন লাইন। আর মাঝি-মাল্লা কৃষকতো হর হামেশাই সুর তুলতো। কিন্তু এখন চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে ইট পাথর আর ভিন জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল। সংকুচিত হচ্ছে নদী, গ্রাম, খাল, বিল ; এমন কি হারিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব গারো ভাষা। এ অবস্থায় বাংলার রূপের বর্ণনা বা নাড়ীর টানের সেসব সুর ও কথা কীভাবে আসবে !

এমতাবস্থায় গারোহাব মিডিয়া পরিবার মনে করেন, এই পরিবেশ থেকে গারোদের প্রকৃত কথা ও সুর তুলে ধরা কঠিন। তবে ভাবনা জগত অনেক বড়। মানুষ চাঁদে বা স্বর্গে না গিয়েও সে সম্পর্কে লিখছে। ইচ্ছে থাকলে সেরকম ভাবনার পরিধি ভেঙ্গে অনেক কিছুই করা যায়।

লুই সাংমা

সংস্কৃতি কর্মী

পুনশ্চ: আরও তথ্যের জন্যে গারোহাব আর্কাভ ভিজিট করুন (https://garohub.com)