বিশ্বে করোনা ভয়াবহতা কাটেনি, তাতে কি! স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ব্যাকুল সবাই। ঘরে আবদ্ধ আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলকে ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত করেছে। পত্র পত্রিকা খুললেই অনলাইনে কাজ সম্পাদন করতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর সবার চোখ পড়ে। বলা বাহুল্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে কাজগুলো সহজ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ করিয়ে নেয়ার প্রবনতাও বহুগুন বেড়ে গেছে।

পাশাপাশি কেউবা ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিকে সৎ ব্যবহার করে পেশাদারিত্বের মাধ্যমে অর্থ উপর্জনের পথ খোঁজে পেয়েছে। তেমনি একজন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের আদিবাসী মেয়ে সোনা আলো চাকমা। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বন্দুকভাঙ্গা রাঙ্গামাটি। চাকরীসূত্রে, দুটি সন্তান নিয়ে বসবাস করেন বান্দরবান জেলায়।

চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া থানাস্থ এক কলেজ থেকে তিনি বি.এ পাশ করে ব্রাক, আশা নামক এনজিওতে ফিল্ড অফিসার পদে উন্নয়নসংস্থাগুলো সফল উন্নয়ন কর্মী হিসাবে মানুষের সেবা দান করেছেন। এবং পরে ২০১০ সাল থেকে অধ্যাবধি তিনি বান্দরবান শহরে হিউমেনিটারিয়ান নামক সংস্থায় শিক্ষা বিভাগে হোস্টেল সুপার পদে কর্মরত। এভাবেই তিনি মানুষের দু :খ দুদর্শার দীর্ঘশ্বাস, জীবন সংগ্রামের ঘ্রাণ খুব কাছে থেকে নিয়েছেন। ঠিক এমন কিছু দীর্ঘশ্বাস নিজের শ্বাস প্রশ্বাসে ফিরে ফিরে আসতো।

বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী এবং দুজনের উপার্জন মাস শেষে সেভিংস বলতে কিছুই থাকে না। অভাবী সংসারে ইচ্ছে আর স্বপ্নের সমন্বয় হলেও; অর্থোভাবে স্বপ্ন ফুলকলিগুলো প্রষ্ফুটিত হতে পারেনি। ফলে নিজের মধ্যে কিছু করতে না পারার দু:খবোধগুলো জমাধ বাঁধতে শুরু করে। প্রায়শই ধুমরে মুচরে হৃদ্য কেঁদে ওঠে একা একা।

নিজে স্বাবলম্বীর লক্ষে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ নিজ হাতেই শুরু করেন। চাকরীর পাশাপাশি মহিলা গ্রাহকের চাহিদা, এবং বাচ্চাদের বাহারি পোষাকের অর্ডার নিতেন। এ বছর করোনা পরিস্থিতিতে ঘরে আবদ্ধ থাকা জীবন আলো চাকমা’র চলার গতিকে যেন আরও বাড়িয়ে দেয়। ঘরোয়া সেলাইয়ের পাশাপাশি; আর্থিক দৈন্যতা উপেক্ষা করে সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যবসায়। অর্থাৎ আরও দশ হাজার টাকা পুঁজি খাঁটিয়ে তিনি ভার্চ্যুয়াল অর্ডার নিয়ে গ্রাহকের পণ্য বিপণন সেবা যুক্ত করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে ট্রেডিশনাল, দেশজ ও শুদ্ধ পণ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিপণন এর মাধ্যমে জাতিগত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগুলো উন্মুক্তকরণ এবং সার্বজনীন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা।

স্বামীর সহায়তায় স্বত্তাধিকারী সোনা আলো চাকমা নিজে ঘরে বসে ফেইসবুকে মার্কেটিং এবং গ্রাহক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিকাশের মাধ্যমে অর্থিক লেনদেন এবং এস.এস পরিবহন ব্যবহার করে গ্রাহকের অর্ডারগুলো ডেলিভারি সুবিধা দিয়ে থাকেন। আ.বিমা টাইমস নিউজের বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে উনার কিছু বর্নণাকৃত কথাগুলো হুবহু তুলে দেয়া চেষ্টা করা হলো….

আমার অনেক পণ্য সামগ্রীগুলো মূলত সবই ট্রেডিশনাল বিশেষ করে আদিবাসীদের ব্যবহৃত বাহারী চাকমা ট্রেডিশনাল পন্য যেমন – ট্রেডিশনাল ড্রেশ থামি, হাদি, ফিনন, ওড়না, কুটি এবং এ ছাড়াও বার্মিজ লুঙ্গি, গামছা, মাহিলাদের ব্যবহৃত কাপড় চোপড়, ছেলেদের জন্য ব্রান্ডের টি শার্ট, শর্ট পেন্ট, ইত্যাদি। খুবই কোয়ালিটি সম্পন্ন পণ্য বলা যায়। গ্রামের দক্ষ কারিগর দিয়ে তৈরী কাপড়-চোপড় তদারকি করে সেগুলো সংগ্রহ ও কোয়ালিটি মেইনটেইন করে থাকি। সফলভাবে গ্রাহকদের কাছে আমার পণ্যগুলো পৌঁছে যায়; আর সে কারনে আমার সেবায় গ্রাহকরা সন্তোষ্ট এবং অতি অল্প সময়ে উদ্যেক্তা হিসাবে পরিচিতি লাভ শুরু করেছি।

এছাড়াও ভবিষ্যতে দেশ এবং বিদেশের গ্রাহকের চাহিদাকে মাথায় রেখে আদিবাসীদের ব্যবহৃত এবং পরিবেশ বান্ধব তৈজসপত্র বাজারজাত করনের ইচ্ছেও রয়েছে। ইতোমধ্যে ইন্ডিয়া, নেদারল্যান্ড, এবং ফ্রান্স থেকে গ্রাহকদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আদিবাসীদের যেকোন পণ্য সামগ্রী ক্রেতাদের নজর কাড়ে সবার আগে। এটি তৈরি ও ব্যবহারের ইতিহাস অত্যন্ত হৃদ্য় ছুয়ে যাওয়া সুন্দর গল্প বলে। ভালো লাগে সকলেরই। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের ব্যবহারের মানসিকতা বদলে গেছে এবং দিনকে দিন বাড়ছে। ব্যতিক্রম এবং পরিবেশ বান্ধব পণ্য বদলে দেয় আপনার ঘরের রুপ।

যদি সফল উদ্যোক্তা হতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে পরিকল্পনাগুলোকে আরও প্রসারিত করে এলাকার বেকার যুবক যুবতিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার পরিকল্পনাও আছে।

শেষে তিনি মৃদু কন্ঠে বলেন, করোনায় কারোর করোনা নয়; তিনি সবার সহায়তায় হতে চান একজন সফল আদিবাসী নারী উদ্যোক্তা। ভবিষ্যতে ‘জয় ফ্যাশান’ নামে বিপণন প্রতিষ্ঠানটি নামকরণের কথা রয়েছে।

করোনা ভাইরাস গোটা বিশ্বের জীবন-যাত্রা ঝিমিয়ে পড়েছে; অন্যদিকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয় যুগিয়েছেও বৈকি!ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ দৃঢ় সংকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে; এবং সোনা আলো চাকমা তাদেরই একজন। মানুষের দৃঢ় মনোবল এবং অদম্য ইচ্ছা শক্তিই পৌঁছে দিতে পারে গন্তব্যে। কিছু সফল উদ্যোক্তাদের পেছনের গল্প সুখকর ছিল না, অথচ নিজের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে সাফল্য পেয়েছে। শুধুমাত্র অর্থ থাকলে সফলতা পাওয় যায় না; অর্থহীন হলেও নিজ প্রচেষ্টায় যৎ সামন্য পূঁজিতে উদ্যোক্তা হিসেবে অনন্য উচ্চতায় উঠেছে ; এমন নজির আমাদের চারপাশেই রয়েছে। সামান্য পূঁজি নিয়ে ঘরোয়া উদ্যোগে পণ্য বিপণনে সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন ক্ষুদ্র পাহাড়ি নারি উদ্যোক্তা সোনা আলো চাকমা।