ভন্ডদের কাছে হাজারটি অস্ত্র নেই। ফলে ভন্ড মানুষ কিন্তু ভয়ংকর রকমের সাহসী। এই সাহস কিন্তু সে একা তৈরি করেনি। এই সাহস কোন গ্যাং তৈরি করেছে। যে দেশে এখনও ভুত তাড়াতে ঝাড়ু পিটা করা হয়, চোর ধরতে চালপড়া খাওয়ানো হয়, সাপ কামড়ানো রুগিকে ওঝা ডেকে বিষ নামানোর চেষ্টা করা হয় সেই দেশে নতুন ইশা নবী জন্মাবেই। সে দেশে আধুনিক এই ইশা নবীর ভক্তও বাড়বে।

তখন আমি ৮ম কি ৯ম শ্রেণির ছাত্র। মধুপুরের জলছত্রের কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। প্রয়াত ফাদার তামস আজিম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তখন ম্যাজিক দেখাতেন। সেখান থেকেই ম্যাজিসিয়ান হওয়ার প্রবল আকাঙ্খা জন্মেছিল আমারও। আমি অনেকগুলো ম্যাজিকের ভিতরের রহস্য নিজে নিজে উম্মোচন করা চেষ্টা করতাম। কিন্তু সফল হয়নি। অবশেষে ম্যাজিক শিখার বই কিনতে শুরু করলাম। স্টাডি রুমের ড্রয়ারে ছোট ছোট ম্যাজিক শিখার বই জমতে শুরু করল। অনেক কিছু শিখলাম কিন্তু কাউকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত সাহস আমার হয়নি। দেখাতে গেলেই কোথাও না কোথাও তালগোল লেগে যেত। আবার কাউকে দেখতাম দুটা যদু মদু টাইপের ম্যাজিক জেনেই উলটো আমাকে তাগ লাগিয়ে দিতো। বিষয়টা আসলে শিখার না বিষয়টা প্রয়োগের। শিখা যায় কিন্তু প্রয়োগ করার বা উপস্থাপন করার স্কিল সবার থাকে না। কথাটা এই কারনেই বলছি হাত আর মগজের সুনিপুন কসরত ব্যাবহার করে আপনি শুধু মাত্র একটি ম্যাজিক শিখেই দশজনকে বিমোহিত করে দিতে পারেন। কিন্তু সেই কসরত যদি সুনিপুন ভাবে আপনি দেখাতে না পারেন তবে যতই ম্যাজিক জানা থাকুক না কেন কাজে আসবে না।

এখন বলি ভন্ডদের কথা। এরা আসলে কোন না কোন সেন্সিটিভ বিষয় নিয়ে আপনাকে মগজ ধোলাই দেবে। তার কাছে হাজারটি অস্ত্র নেই। আছে দু একটি যেটি সে সুনিপুন ভাবে আপনাকে বশ করে নিতে ব্যাবহার করতে পারে। একটা উদাহারণ দেই। আমি হুমায়ুন আহমেদের একজন বিগ ফ্যান। তাঁর বই সামনে যা পেয়েছি সেগুলো গাপুসগুপুস করে গিলেছি। তাঁর একটি বইয়ে একটা বিষয় লেখা ছিল জ্যোতিষী হয়ে উঠা কোন বিষয় না। কারো মনের কথা গরগর করে বলে দেওয়াটাও কোন বিষয় না। এই ধরুন আমি আপনার হাত দুবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আপনার দিকে গম্ভির দৃষ্টিতে তাকালাম। তারপর বললাম, ভাই তোমার জীবনে কিন্তু অনেক বাধা বিপত্তি আছে; কিন্তু তুমি এখনও যুদ্ধ করে টিকে আছো। তারপর বললাম, আরে আপনার জীবনেতো অতিতে একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে দেখি ! তারপর আবার কিছুক্ষণ পর বললাম, ভাই আপনি আসলে এমন মানুষ আপনি যা চান মানুষেরা সেটা বুঝে না। আপনি কি সেটা আপনিই জানেন। আপনার ভবিষ্যতে আমি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পাচ্ছি। আর- ব্যাস আপনি মাথা নাড়বেন; আর বলবেন, বাহ আপনি এতকিছু কিভাবে জানলেন? এরপরই লোকটা আপনাকে প্রচন্ড রকমের বিশ্বাস করে বসবে। কেন জানেন? এই পৃথিবীর সকল মানুষই নিজেকে রহস্যময় ভাবতে পছন্দ করে। এটি কিন্তু আমার কথা না হুমায়ুন আহমেদ এর কথা। এইভাবে একজন মানুষকে অনেক সহজেই হিপোটাইজড করা যায়। আর এই কৌশল কাজে লাগিয়ে একজন ভন্ড জুটিয়ে নিতে পারে আপনার মন। আর আপনি হয়ে উঠতে পারেন সেই ভন্ডের ভক্ত। এইভাবে এক ভক্ত আরেক জনকে ধরে আনে আবারও একই অস্ত্র চালায় ভন্ড আবারও বাড়ে ভক্তের সংখ্যা।

কত সাল ঠিক মনে পড়ছে না। তখন আমি বিভিন্ন অলৌকিক বিষয় বা গুজব ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামায়। সংবাদ সংগ্রহ করি। তখনই একটি এলাকায় আরেকজন দাবি করে বসলেন তিনি যীশু খ্রীস্টের দর্শন পেয়েছেন। প্রতিদিন হাজার মানুষ তার কাছে ভীর করছেন সুস্থ হওয়ার জন্য। আমি ছুটে গেলাম সেই মানুষটার বাড়িতে। মানুষটা আমার বাবাকে চিনতেন আর আমি মিডিয়া কর্মী পরিচয় দেওয়ার কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেন। অনেক বলে কয়ে তার সাথে একান্ত আলাপের সুযোগ পেলাম। বাইরে হাজার ভক্তের ভীর উপেক্ষা করে আমি তার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ ডুমে গেলাম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝ নদীতে। ছবি তুলে আর কথা রেকর্ড করে ফিরব তখন দেখলাম দর্শনপ্রাপ্ত মানুষটার বাড়িতে ক্রাউড কন্ট্রোলের জন্য স্বেচ্ছা সেবক দলও রাখা হয়েছে। তাদের সবার হাতে লাঠি। কি করব কি বলব না ভেবে মুচকি হাসি দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। তিনি এমন কথাগুলো বললেন মনে হচ্ছিল আমিও তার প্রতি বিশ্বাস করে ফেলি। এই যে কথাগুলো এই কথাগুলো কিন্তু আসলেই তারা দর্শন থেকেই পেয়েছেন। দর্শন বলতে বহুদিনের কষ্টে অর্জিত কিছু ট্রিক্স । যে ট্রিক্স দেখতে আসা সব মানুষই খায় কিন্তু সবার পায়ুপথ দিয়ে বেড় হয়ে যায় না। আর যাদের পায়ুপথ সেগুলো বের করে দিতে পারে না তারা থেকে যান ভক্ত হয়ে।

হালুয়াঘাটের ইশা নবী বা খ্রীস্টানদের যীশুর কথা কেই বা না শুনেছে ! মানুষটা কিন্তু ভয়ংকর রকমের সাহসী। এই সাহস কিন্তু সে একা তৈরি করেনি। এই সাহস কোন গ্যাং তৈরি করেছে। হঠাৎ গ্যাং এর কথা বলার কারনও আছে। সেই যে যীশু দ্বারা দর্শন প্রাপ্ত ব্যাক্তিটির বাড়ি গিয়েছিলাম ! সেখান কার স্বেচ্ছা সেবকরা কিন্তু শুধু স্বেচ্ছা সেবকই ছিল না। তারা ধীরে ধীরে মানুষটিকে সাপোর্ট দিয়ে সত্য মিথ্যার যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিল। আর এই সন্দীপ রিছিল মানুষটাও বোধয় একা না। একা না দেখেই, আশেপাশে সাপোর্ট ছিল দেখেই, সফল কসরত কারবারি করেছে দেখেই কিছু ভক্তও জন্মে গিয়েছে। যে দেশে এখনও ভুত তাড়াতে ঝাড়ু পিটা করা হয়, চোর ধরতে চালপড়া খাওয়ানো হয়, সাপ কামড়ানো রুগিকে ওঝা ডেকে বিষ নামানোর চেষ্টা করা হয় সেই দেশে নতুন ইশা নবী জন্মাবেই। সে দেশে আধুনিক এই ইশা নবীর ভক্তও বাড়বে। তাকে জেলে ভরে রাখলে সে এও বলবে, মানব পুত্র যীশু যতবার জন্ম নিয়েছে তার ভাগ্যে শুধু অত্যাচার অনাচারই জুটবে। কারণ এই দাবিদার চালাক বান্দা জানে কেউ একদিন, কেউ না কেউ তার এই ভণ্ডামির বিপরীতে উচিত শিক্ষা দেবেই। লেখাটি পড়ে কোন ভক্তের হৃদয় ভেঙে দেওয়া গেলে মন্দ হবে কি?

লেখকঃ বাপন নেংমিঞ্জা
জুন ২, ২০২২