যে কল্পনার বিচার হয়নি গেল চব্বিশ বছরে, আরও চব্বিশ বছর যোগ করলেও কল্পনা চাকমার বিচার হবে কি? নাকি কল্পনার ন্যায্য বিচার অধরাই রয়ে যাবে!

সুপরিচিত পাহাড়ি নাম কল্পনা চাকমা। ১৯৯৬ সালের ১২জুন, কল্পনা চাকমা অপরহণের আজ পূর্ণ হলো ২৪ বছর। চব্বিশ বছর গড়ালেও জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেল, সত্যিই কল্পনা চাকমা হারিয়ে গেছে, নাকি তাঁকে রাজনৈতিকভাবে হারিয়ে যেতে বাধ্য করেছে? যদি বাধ্য করে থাকে তাহলে কি ছিল তাঁর মহা অপরাধ? সহসায় আরও প্রশ্ন জাগে মনে, আজ কেমন আছে সেই চিরচেনা কল্পনার পাহাড়?

যদি বলি কল্পনা চাকমার কি অপরাধ ছিল; আরও যদি বলি কেমন আছে কল্পনার চিরচেনা পাহাড়? কল্পিত কোন গল্প নয়, বাস্তব গল্পটি বললে আপনি হতবাক হতে বাধ্য। তিনি পাহাড়কে নিপীড়নমুক্ত, শোষণ বঞ্চনা থেকে রক্ষা করার জন্য কল্পনা নিজেকে সর্বোত্তমভাবে তৈরি করেছিলেন। কল্পনার সেই পাহাড়ে আজও থামেনি নিপীড়নের সংস্কৃতি। আজও সামান্য, তুচ্ছ ঘটনায় জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। দিনের পর দিন চলছে ধড়পাকড় আর অপহরণ। চারদিক বাজছে নানা দিক থেকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। এর মধ্যে অজস্র প্রাণ ঝরে গেছে। পাহাড় ভেঙে চলেছে অনবরত। শুধু অঞ্চল ভাঙেনি, রাজনৈতিক দলগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত হচ্ছে। চর্চিত হচ্ছে নিপীড়নের নতুন নতুন কৌশল। এখন শত্রু-মিত্র চেনা বড়ই কঠিন। প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে এর পরিচয়। এর মধ্য দিয়েই নানা রাজনৈতিক গহ্বরে তলিয়ে গেছে কল্পনা অপহরণের আসল এবং সত্যিকার ঘটনাটি।

আদিবাসী বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অপহরণের এক বছর পর করা বহুল আলোচিত শান্তিচুক্তিতেও কল্পনার অপহরণ বা পাহাড়ে নারী নিপীড়ন নিয়ে কোনো ধারা নেই। শান্তিচুক্তির পর কল্পনা বিষয়ে অনেকটাই চুপ থেকেছেন চুক্তি সম্পাদনকারী পাহাড়ি নেতারাও। শুধু কল্পনাই নন, পাহাড়ের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে যেসব নারী যুক্ত ছিলেন, পুরো শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ায় তাঁদেরও দূরে রাখা হয়েছে। এখন শুধু কল্পনার অপহরণ দিবসে দু-চারটা কথা বলা হয়। কল্পনা বুঝতে পেরেছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের শক্ত বোঝাপড়াকে।

আদিবাসী বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, কল্পনার এই অপহরণ বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা এনে দেয়। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন একটা বড় সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ঘেঁষা ছিল। আদিবাসী নারীদের বিষয়াবলি একেবারেই গুরুত্বহীন থেকেছে মূল ধারার নারী আন্দোলনে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন চর্চিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী ঘরানার নারী আন্দোলনে কল্পনার অপহরণ প্রথম পাহাড়ি এবং বাঙালি নারী আন্দোলনের মধ্যে সেতু স্থাপন করে। তখন থেকে নারী আন্দোলনে পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসী নারীদের বিষয়গুলো স্থান পেতে শুরু করে। শুধু তা-ই নয়, কল্পনা স্থান পান প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভার্চ্যুয়াল প্রতীক হিসেবে এখনো সদা জাগ্রত সকলের কাছে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ অভিযোগ, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন দিবাগত রাতে রাঙ্গামাটি জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউলাল্যাঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে পার্শ্ববর্তী কজইছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার লেঃ ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল ভিডিপি ও সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক নির্মমভাবে অপহরণ করা হয়।

ফলশ্রুতিতে কল্পনা অপহরণ ঘটনার প্রতিবাদে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ডাকা ২৭ জুন ১৯৯৬ অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ চলাকালে আবার তৎকালীন বাঘাইছড়ি সেনা কর্তৃপক্ষের মদদে স্থানীয় ভিডিপি ও সেটেলারদের সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবুপাড়া ও মুসলিম ব্লক এলাকায় গুলি করে রূপন চাকমাকে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

সেই বহুল আলোচিত কল্পনার মামলাটি ২০১৬ সালে তদন্ত শেষের ঘোষণা দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ এবং সেই সঙ্গে মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লোজ করে দেওয়া হয়। সাধারণত কোনো মামলার তদন্তে কিছু না পেলে মামলাটি আর এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না বলে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, সেটিকে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলে গ্রহণ করা হয়। কল্পনার অপহরণের অনেক বছর পরও বেঁচে ছিলেন কল্পনার মা। কল্পনাকে যখন বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়, তখন তাঁর মা এবং দুই ভাই বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু তার পরও বলা হয়েছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলেই পুরো মামলাই মরে গেছে বলে অনেকেরই ধারণা।

অর্থাৎ কল্পনা অপহরণ ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার মুখে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও বিগত ২৪ বছরেও সরকার সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।

উক্ত অপহরণ ঘটনার পরপরই কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার অভিযোগ স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।

এরপর আদালতের নির্দেশে একে একে চট্টগ্রাম জোন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কয়েকজন পুলিশ সুপার রাঙ্গামাটির চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একের পর এক ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ দাখিল করেন। নামে এগুলো ‘তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন’ হলেও বাস্তবে তদন্তে কোন কিছুই অগ্রগতি নেই।

সর্বশেষ কল্পনা অপহরণ মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা ইতোমধ্যে উক্ত ৩৯তম তদন্তকারী কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

এহেন পরিস্থিতে শেষমেশ আরও প্রশ্ন জাগে মনে, যে কল্পনার বিচার হয়নি গেল চব্বিশ বছরে, আরও চব্বিশ বছর যোগ করলেও কল্পনা চাকমার বিচার হবে কি? নাকি কল্পনার ন্যায্য বিচার অধরাই রয়ে যাবে!

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ব্লগার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী
তথ্য সহায়ক:
হিল ভয়েস, রাঙ্গামাটি।