বয়সের ভারে ন্যূজ জনিক নকরেক। ঘরের ভেতর বাপাশ হেলে শুয়েছিলেন। গারোহাব দলটি শুয়ে থাকা মানুষটির পাশে বসে কয়েকবার ডাকা হলো। অনেক ডাকা-ডাকিতে একটু বোধয় নড়ে উঠলেন; আবার পাশ ফিরিয়ে ফের শুয়ে গেলেন। কিন্ত কোন কথা বললেন না তিনি। কথা বলার উচ্ছে থাকলেও তিনি কথা বলার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন; তা কেইবা জানতো! যে মানুষটি উদার মনে সকলের তরে আজীবন জ্ঞান বিলিয়েছেন, আজ কেন জনিকের অঝোর ধারায় এতো অভিমান!

অনলাইন সংবাদ, গারোদের চালচিত্র পরিবেশনে নতুন মুখ আ.বিমা টাইমস নিউজ পোর্টাল। মিডিয়া পরিবারটির দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল গারোদের অতীত ধর্মাচার, এদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং বর্তমান সময়ে গারোদের জীবন-যাপন, ইতিহাস ও বিভিন্ন শিক্ষনীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে ডকুমেন্টরি আকারে শর্ট ফিল্ম তৈরি করে ভার্চ্যুয়াল আর্কাভে সংরক্ষণ করা। যাতে করে নতুন গারো প্রজন্মরা দেখতে পারে। গারোদের খুটিনাটি বিষয় দেখতে পারে, শিখতে ও জানতে পারে। আদি শেকড়গুলো খোঁজে পেতে পারে। নতুন চেতনায় আবার উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

পরিকল্পনানুযায়ী আ.বিমা টাইমস ২৪ নিউজ পোর্টালের সিস্টার কনসার্ন ‘গারোহাব’ পরিবারের একটি দল গারোদের বিশেষ ভিডিও ফোটেজ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও সংরক্ষণের নিমিত্তে মধুপুরের মাটিতে পা রাখে বৃহস্পতিবার। দলটির উদ্দেশ্য ছিল মধুপুর আ.বিমায় সাংসারেক ধর্মের ধারক বাহক খামাল জনিক নকরেক, খামাল দীনেশ নকরেকসহ অতীতের ইকোপার্ক আন্দোলন, এবং চলমান আন্দোলন সংগ্রামের সাহসী তরুণ শহীদ পীরেন স্নাল, উৎপল নকরেকসহ সেসময়ের স্মৃতিকথা, এসব কিংবদন্তিদের গল্প তুলে আনা। পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী দলটি শুক্রবার পা রাখে জনিক নকরেকের জীর্ণ মাটির ঘরে। গভীর প্রত্যাশা ছিল স্থির চিত্র, সাংসারেক নিয়ে অনেক গল্পগুজব, জমপেশ আড্ডা হবে। ভিডিও চিত্র ধারণের মধ্য দিয়ে তার পেছন গল্প শুনা হবে, শুনা হবে সাংসারেক ধর্মে পূজার সাসাৎ সোয়া ধোঁয়ার সঙ্গে মন্ত্রধ্বনি।

সাংসারেক খামাল জনিক নকরেক এর শেষকৃত্যানুষ্ঠান, মিল্লাম স্ফী হাতে জীবিত খামাল দীনেশ নকরেক

বয়সের ভারে ন্যূজ জনিক নকরেক। ঘরের ভেতর বাপাশ হেলে শুয়েছিলেন। গারোহাব দলটি শুয়ে থাকা মানুষটির পাশে বসে কয়েকবার ডাকা হলো। অনেক ডাকা-ডাকিতে একটু বোধয় নড়ে উঠলেন; আবার পাশ ফিরিয়ে ফের শুয়ে গেলেন। কিন্ত কোন কথা বললেন না তিনি। কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তিনি কথা বলার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন; তা কেইবা জানতো! যে মানুষটি উদার মনে সকলের তরে আজীবন জ্ঞান বিলিয়েছেন, আজ কেন জনিকের অঝোর ধারায় এতো অভিমান!

গারো সাংসারেক ধর্মের প্রাসঙ্গিক কিছু ইতিহাস ও ভৌগোলিক অঞ্চলসমূহ- গারোরা মূলত ভারতের মেঘালয়  ও বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় বসবাস করে। ভারতের মেঘালয় ছাড়াও আসামের কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও কারবি আংলং জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকাও গাজীপুর জেলায় গারোরা বাস করে। তবে ঠিক কবে নাগাদ থেকে বাংলাদেশে এই গারো আদিবাসীরা বসবাস শুরু করেছিল তা অনেকেরই এখনো অজানা।

সাংসারেক খামাল জনিক নকরেক এর শেষকৃত্যানুষ্ঠান

গারোরা ভাষা অনুযায়ী বোডো মঙ্গোলীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে অনেক গারোই নিজেদেরকে মান্দি বলে পরিচয় দেন। গারোদের ভাষায় ‘মান্দি’ শব্দের অর্থ হল ‘মানুষ’।  গারোদের সমাজে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা প্রচলিত। তাদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের নাম ‘ওয়ানগালা’; যাতে দেবতা মিসি আর সালজং এর উদ্দেশ্যে উৎপাদিত ফসল উৎসর্গ করা হয়। উল্লেখ্য ওয়ানগালা না হওয়া পর্যন্ত মান্দিরা নতুন উৎপাদিত ফসলাদি খেত না। আশ্বিন মাসে একেক গ্রামের মানুষদের সামর্থ্যানুযায়ী সাত দিন কিংবা তিনদিন ধরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। অতীতে গারোরা সবাই তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। তাদের আদি ধর্মের নাম ‌’সাংসারেক’। ১৮৬২ সালে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে বর্তমানে ৯৯ ভাগের বেশি গারোরা এখন খ্রীষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণের পর থেকে তাদের সামাজিক নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠানে বেশ পরিবর্তন এসেছে।

গারো সাংসারেক ধর্মের প্রধান দেবতার নাম তাতারা রাবুগা। এছাড়াও অন্যান্য দেবতারা হলেন- মিসি সালজং, সুসমি, গয়ড়া প্রমুখ। গারোদের এই সাংসারেক ধর্ম কবে, কোথায় এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল তা এখনো অজানা। ত্যাঞ্চলে খিয়াংরা কবে, কোথায়, কখন এবং কিভাবে জীবন যাত্রা শুরু করেছিল তা অনেকের অজানা । তবে এটা সত্যি যে, এই সংখ্যালঘূ খিয়াংরাও অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে সহবস্থানে থেকে যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে । অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে সাথে খিয়াংরাও এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিল বলে অনেকেই অভিমত পোষণ করেছেন । কারণ খিয়াংদের প্রাত্যহিক জীবনের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতি ও পূজা পার্বণ ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্যান্য আদিবাসীদের সাথে অনেকটা সামঞ্জস্য রয়েছে । এক সময় ছিল যখন তারা নিজেদের বৈদ্যান্তিক শক্তি দ্বারা মন্দ দেব-দেবীদের নিয়ন্ত্রণ ও পূজা-অর্চণা করতো। আর তাদের নিজস্ব কবিরাজি বিদ্যা দিয়ে পাহাড়ি গাছ-গাছালি দ্বারা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দিতো । এই সকল বিদ্যা তারা পুরুষানুক্রমে রপ্ত করতো । কালের আবর্তে মিশ্র সংস্কৃতির আবহের কারণে তাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বৈদ্যান্তিব বিদ্যা এবং কবিরাজ শান্ত্র চিরতরে হারিয়ে গেছে । তাছাড়া ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে এবং শিক্ষার অভাবে সংরক্ষিত না থাকার কারণে অনেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানাদি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । ঠিক তদ্রুপ খিয়াংদের বিভিন্ন পূজা-পার্বন ও হারিয়ে যেতে বসেছে । তাছাড়া সমাজের তাদের নিজস্ব আইন কানুন দ্বারা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করত । এছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীদের বিভিন্ন পূজা সম্পর্কেও তাদের ভাল জ্ঞান বা ধারণা ছিল । যে কেউ ইচ্ছা করলে বিভিন্ন দেবতা-দেবীর কাছে পূজা দিতে পারতো না । এই বিষয়ে দক্ষ লোকেরাই এ সকল পূজা দিতে পারতো । কোন গ্রামে যদি খিয়াংদের মধ্যে পূজা দেবার মত অভিজ্ঞ লোক না থাকত, তাহলে অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের এনে সেই পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হতো । এভাবে একে অপরের সহায়তায় পূজার কাজ সম্পন্ন করা হত বলে অন্য আদিবাসীদের পূজার সাথে অনেকটা সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। ঠিক তদ্রুপ কোন আদিবাসীর গ্রামে যদি পূজা দেবার মত কোন দক্ষ লোক না থাকত, তাহলে খিয়াং সম্প্রদায়ের দক্ষ লোককে নিয়ে গিয়ে পূজার কাজ সম্পন্ন করতে হত । অতীতে খিয়াংদের পূজার কাজে বা বৈদ্যান্তিক ধ্যাণ ধারনার বিদ্যায় যথেষ্ট সুনাম ছিল । অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাদের বৈদ্যান্তিক বিদ্যার পারদর্শিতার জন্য বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করত বলে জানা যায়। অনেকের ধারণা মতে খিয়াংরা প্রাকৃতির পূজারী ছিল। তারা প্রাকৃতিক বিভিন্ন উৎস বা শক্তিকে পূজা করতো । এখনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াংরা বিভিন্ন দেব-দেবীর কাছে তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে পূজা দিয়ে থাকে ।

কে এই সকল পূজা দিতে পারে? যিনি সাধারণত বিশেষভাবে পূজা দেবার কাজে অভিজ্ঞ সেই লোকই পূজা দিতে পারত । এই পূজা দেবার কাজে অভিজ্ঞ লোককে খিয়াং ভাষায় বলা হয় ‘æনাত সারা’ । এর বাংলা অর্থ ভূতের শিক্ষক । এই নাত সারাকে কিছুটা হলেও মন্ত্র-তন্ত্র বিদ্যা জানতে হয়। নতুবা পূজা দিতে গিয়ে সেই ভুত বা দেবতাকে দমিয়ে রাখতে না পারলে হিতে বিপরিত হবার সম্ভাবনা থাকে বলে নিজেদের আত্ম রক্ষা মূলক মন্ত্র-তন্ত্র বিদ্যা অর্জন করতে হয় ।

রোদের আদি ধর্ম মতে তাদের কোনো সদস্য মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে রাং-থ্রাম বাজিয়ে মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হয়। শোক সংবাদ শুনে আত্মীয়স্বজনরা ছুটে আসে। মৃত ব্যক্তিটি যদি পুরুষ হয়, তাহলে মৃত্যু সংবাদ প্রথম পাঠাতে হয় মৃতের মাতৃগোষ্ঠীর কাছে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গারো পুরুষদের সাধারণত স্ত্রীর বাড়িতে চলে যেতে হয়। মৃত্যুর সংবাদ শুনে মা-বাবা তড়িঘড়ি চলে আসতে পারেন না। আর্থিক অবস্থাভেদে মা-বাবাকে ষাঁড় বা গরু, ছাগল, শূকর, মোরগ-মুরগি ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় মৃতের বাড়িতে। সাংসারেক গারো সদস্যের মৃত্যুর পর তার মায়ের গোত্রের মেয়েরা এসে মৃতকে স্নান করায়। মৃত ব্যক্তি ধনী হলে সে ক্ষেত্রে চু বা গারো মদ দিয়ে তার মরদেহ স্নান করানোর নিয়ম রয়েছে। আবার গরিব হলে জল দ্বারা স্নান করানো হয়।

সাংসারেক রীতিনুসারে গারো সাংসারেক বিশ্বাসী শেষকৃত্যানুষ্ঠান- সাংসারেক গারোরা জন্মান্তরে বিশ্বাসী। হিমাংশু মজুমদার তার ভারতের আদিবাসী গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মৃত্যু সম্পর্কে গারোদের বিশ্বাস; শরীরের মাঝে আত্মা বাস করে। মৃত্যুর ফলে আত্মা শরীর ছেড়ে মাংরু এবং মাংরাম নামক স্থানে চলে যায়। মাংরু এবং মাংরাম হল আত্মার ভালো-মন্দের বিচারের স্থান। যতদিন না পুনর্জন্ম হয় ততদিন আত্মা সেখানে স্থায়ী হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তাদের মতে মৃত্যুর কারণ অনুযায়ী আত্মার পরিণতি ঘটে। যেমন কেউ ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলে সে গোবরে পোকারূপে পুনর্জন্ম নেয়। আবার বাঘ বা হাতির আক্রমণে নিহত হলে বা মারা গেলে সে জন্তুরূপে জন্ম নেয়। কখনও আর মানুষরূপে পুনর্জন্ম নিতে পারে না।

অন্যদিকে সুভাষ জেংচাম তার ‘বাংলাদেশের গারো সম্প্রদায়’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, গারোদের (সাংসারেক গারোদের) বিশ্বাস জন্মান্তর গ্রহণের প্রস্তুতি পর্বে বিদেহী আত্মা সাময়িকভাবে চিকমাং পাহাড়ে অবস্থান করে। এ চিকমাং পাহাড়টি গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। যা বাংলাদেশের কলমাকান্দা দুর্গাপুর এলাকা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সড়কপথে ভ্রমণ করলে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা পথে শ্যামগঞ্জ থেকে শুরু করে নেত্রকোনা ঠাকুরাকোনা থেকেও উত্তর দিগন্ত বরাবর তাকালে চিকমাং পাহাড় চূড়াটি দেখা যায়।

মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রে গারোদের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে ভিন্ন ভিন্ন রীতি প্রচলিত। কোনো কোনো গোত্রে মরদেহ আগুনে পোড়ানো হয়। আবার কোনো গোত্রে মাটিতে সমাহিত করা হয়। অবশ্য মাটিতে পুঁতে রাখার রীতি শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন কেউ যদি কলেরা, বসন্ত, কুষ্ঠ, কালাজ্বরের কবলে পড়ে মারা যায়, তাদের মরদেহ মাটিতে পুঁতে দেয়া হয় বা সমাধিস্থ করা হয়। সময় তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র মরদেহের সঙ্গে দেয়া হয়। বার্ধক্যজনিত কারণে কিংবা স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সে ক্ষেত্রে মরদেহ কাঠের বেদিতে দাহ করার রীতি রয়েছে। তারা সদলবলে শোভাযাত্রা করে মরদেহ গাংচি বা খাটিয়ায় করে দাহ করার জন্য শ্মশানে নিয়ে যায়। দাহ স্থানে প্রথমে চার কোণে চারটি খুঁটি পুঁতে তার ওপর বড় বড় কাঠ সজ্জিত করা হয়। এ ক্ষেত্রেও মৃতের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র শবদাহের সময় সঙ্গে দেয়া হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস মৃতের আত্মাকে বিভ্রান্ত করার জন্য পরপারে অপদেবতা ওঁৎ পেতে থাকে। তখন মৃতের ব্যবহার্য ওই সব তৈজষপত্র বা অন্যান্য জিনিসপত্র ওই অপদেবতাকে দিয়ে মৃতের আত্মা নির্বিঘ্নে তার গন্তব্যে চলে যেতে পারে। মৃতদেহকে কাঠের ওপর রেখে তারপর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সাধারণত দাহ কাজে মাদার বা পারিজাত গাছের কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দাহ করা মরদেহের অদগ্ধ হাড় ও চিতার ছাই একটি পাত্রে পুরে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। মৃতের সঙ্গে দেয়া জিনিসপত্র অদগ্ধ অবস্থায় থাকলে মৃতদেহ দাহকারী স্বজনেরা সেগুলো নিয়ে যেতে পারে। অতঃপর সে স্থানে ছোট ত্রিকোণাকৃতির একটি ছোট ঘর তৈরি করে খড় দিয়ে ছেয়ে রাখা হয়। সে ঘরকে বলা হয় দেল্লাং। গারোদের বৃহৎ বার্ষিক অনুষ্ঠান ওয়ানগাল্লা। কোনো কোনো গোত্রের রীতি অনুযায়ী ওই ওয়ানগাল্লা বা চুগান পালনের সময় ওসব দেল্লাং বা খ্রমগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মৃতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়।

খামাল জনিক নকরেক এর চিতানল

সাংসারেক রীতি অনুযায়ী কোনো গারো সদস্য মারা গেলে সেখানে রাং থ্রাম বাজিয়ে শোক সংবাদ প্রচার করা হতো, এখন সে স্থান দখল করেছে খ্রিস্ট রীতির ঘণ্টাধ্বনি। ধর্মান্তরিত কোনো গারো সদস্য মারা গেলে মৃত্যু সংবাদ এখনও প্রথমে তার মাতৃগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো হয়। মৃত্যু সংবাদ শুনে এখনও সীমান্তের ওপারে তথা মেঘালয়ে ধর্মান্তরিত গারোদের আত্মীয়স্বজনরা মৃতের বাড়িতে যাওয়ার সময় গরু-ছাগল-শূকর-হাস-মুরগি ইত্যাদি নিয়ে যায়। ওসব পশু-পাখি মেরে সেগুলোর মাংস দিয়ে মৃতের বাড়িতে ভোজনানুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু এপারে অর্থাৎ বাংলাদেশে খ্রিস্টান গারোরা অবশ্য মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটে আসে। যথারীতি খ্রিস্ট নিয়মে মৃতকে কবর দেয়া হয়। তবে মৃতের বাড়িতে কোনো ভোজনানুষ্ঠান হয় না। মৃত্যুর কিছুদিন পর অনুষ্ঠানটি করা হয়, সে সময় আত্মীয়স্বজনরা তাদের সামর্থ্যানুযায়ী গরু-ছাগল-শূকর-হাস-মুরগি ইত্যাদি নিয়ে এসে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ধর্মান্তরিত গারোরা এখন ওয়ানগালা অনুষ্ঠান করে শুধু অতীত ঐতিহ্য রক্ষার জন্য, ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নয়। গারোদের শেষকৃত্য এখন না পুরোপুরি খ্রিস্ট ধর্ম রীতিতে, না আদি সাংসারেক রীতিতে হচ্ছে। বরং বলা যায় উভয় রীতির গ্রহণযোগ্য এক সমন্বিত নিয়মে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ধর্মান্তরিত গারোদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান।

সাংসারেক ধর্ম বা বিশ্বাস আসলে কী- খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করার আগে গারোদের আদি ধর্ম ছিল সাংসারেক এটি দ্রুব সত্য কথা। আজ থেকে প্রায় দেড় বা দু’শো বছর পূ্র্বে গারোরা প্রায় সবাই নিজেদের আদি ধর্ম সাংসারেক পালন করতো। অর্থাৎ গারোরা নৃ-গোষ্ঠী সর্বপ্রাণবাদী। গারোদের আদি ধর্ম Animistic। এহেন Animistic বলতে উপকারী ও অনিষ্টকারী বহু উপদেবতায় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে ঘিরেই গারো নৃ-গোষ্ঠীর জীবনে অসংখ্য কৃত্য বা Ritual বিদ্যমান। তাদের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ মিথ (Myth) বা পুরাণ।

মোদ্দা কথা, গারোদের আদি ধর্ম বহু-দেবতা ভিত্তিক। বিশ্বসৃষ্টির ইতিহাস, মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস, পৃথিবীর জন্ম ও মানুষের বসবাসসংক্রান্ত পুরাণ কাহিনী। এমন কী নৃত্য-গীত-বাদ্যেরও স্বতন্ত্র দেবতা ও পুরাণ বিদ্যমান। অন্য অনেক আদিম জাতির মতোই গারো নৃ-গোষ্ঠী সূর্যপূজাকে সর্বোচ্চ কৃত্য বা Ritual গণ্য করে। এই ধর্মে সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, বজ্র, বৃষ্টি প্রভৃতির পূজার বিধান রয়েছে।  কিন্তু এর পাশাপাশি গারোরা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে। তিনি যে এই পৃথিবীর সবকিছুর স্রষ্টা এ বিশ্বাস গারোদের মধ্যে ছিল। গারোরা একইসঙ্গে মানবদেহে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী এবং সেই আত্মা যে অবিনশ্বর এটাও তারা বিশ্বাস করে। তারাও হিন্দুদের মতো জন্মান্তর বাদে বিশ্বাসী। গারোদের প্রথাগত বিশ্বাস ও সংস্কার সর্বস্ব একটি অনানুষ্ঠানিক কৃষিভিত্তিক ধর্মোৎসব রয়েছে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, ফসল সংরক্ষণ, রোগশোক, মহামারী, ভূত-প্রেত-রাক্ষস ইত্যাদি অদৃশ্য অপশক্তির অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য তারা বারো মাসে তেরো কিংবা ততোধিক ব্রত ও পর্ব-পার্বণ পালন করে।

এই সাংসারেক গারো নৃ-গোষ্ঠী সর্বপ্রাণবাদী। তবে, অন্যান্য ধর্মের মত এ সাংসারেক ধর্মের কোন প্রমানপত্র বা ধর্মগ্রন্থ নেই। আদিমকাল থেকে এই ধর্ম মুখে মুখে এবং ধর্মাচার পালনের মধ্য দিয়ে আজ পর্যন্ত যৎসামান্য টিকে রয়েছে। উল্লেখ্য, গারোদের আদিধর্ম সাংসারেক ধর্মের সাংসারেক ধর্মে প্রায় ৭০০০ দেবতা, উপদেবতা রয়েছে। সাংসারেক ধর্ম অনুযায়ী তারা আকাশ, বাতাস, সুর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্রের পূজা করে, বাস্তুভিটার পূজা করে, ফসলের ভাণ্ডারের পূজা করে, ঘরের খুঁটির পূজা করে। এমনিভাবে সব কিছুতেই তারা প্রাণের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে তাদের দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্ম, উৎপাদন ও জীবন-সংগ্রাম পরিচালিত করে। কিন্ত কালের বিবর্তনে গত পঞ্চাশ থেকে আশি দশকে মধ্যে প্রায় শতভাগ গারোরা খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়। এক কথায় বলা যায়, সাংসারেক অনুসারী এখন প্রায় শূণ্যকোঠায়।

গারোদের আদি ধর্মে বিশ্বাস তথা সাংসারেক সদস্যের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। ১৮৬৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার মি. ব্রনসন নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ ব্যাপটিস্ট মিশনারি আসামের গৌহাটির অদূরে সুখেশ্বর ঘাট নামক স্থানে উমেদ ও রামখে নামে দুজন গারো যুবককে প্রথম খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। সেই থেকে গারোরা খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাবে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করে। এখনও সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অতি অল্প সংখ্যক আদি ধর্ম বিশ্বাসী গারো বা সাংসারেক যারা আজও আদি রীতি মেনে চলছে, তা একদিন শূন্যের কোঠায় পৌঁছবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ধর্মান্তরিত গারোরা তাদের আদি সামাজিক নিয়মাচারের বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

গারোহাব টিমকে জনিক নকরেক এর ছোট মেয়ে বিজন্তি মৃ এই শিকড়তুল্য মানুষের গল্প শুনিয়েছেন। আধুনিক সভ্যতায় নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজেদের আদি শেকড়, সাংসারেক ধর্মকে আঁকড়ে ধরে রাখার রোমাঞ্চকর গল্প শুনে বিমোহিত। এরপর জনিক নকরেকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গারোহাব টিম পথ ধরলো বেদুরিয়া গ্রামের পথে। মাত্র আধা কিলো পথ পেরিয়ে যাবার আগেই ফোন এলো গারো তরুণ নেতা অলিকের ফোন। ফোনে বলছে, জনিক আচ্চু আর নেই। অতপর নির্বাক গারোহাব টিম! বিশ্বাস হচ্ছিল না যার বাড়ীতে মাত্র ১০টা মিনিট আগে গারোহাব টিম তার পাশেই ছিল, যে মানুষটার জন্য সেই উঠোনে কিছুক্ষণ আগে অবস্থান করেছিল আর সেই মানুষটা ছেড়ে চলে গেলো পরপারে। হয়তোবা গারোহাব টিমই ছিলো জনিক নকরেকের শেষ দর্শনার্থী; যার চলে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে তার সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। নিজের ভেতর তীব্র জ্বালা অনুভব করছিলাম এই ভেবে যে; তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আরও বহু আগে কেন এলাম না ! পরক্ষণে নিজের অপরাধী মন বলে, হয়তো এই প্রবীণ সাংসারেক যাজকের শেষ বিদায় জানাতেই এসেছিলাম!

গারো খামাল জনিক নকরেক ছিলেন গারোদের আদি সাংসারেক ধর্মের ধারক ও বাহক। জনিক নরেকের মতোন সকল গারো এলাকাতেও সাংসারেক ধর্মের খামাল, মাদ্দক ছিল। কিন্তু খুদ মধুপুর আ.বিমা শালবনের খামাল জনিক নকরেক ছিলেন অন্যতম। তিনি প্রতি বছর ওয়ানগালাসহ গারোদের সাংসারেক ধর্মের সব ধরণের পূর্জা পার্বন আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন। গারোদের শতাধিক দেব দেবীর নাম তিনি বলতে পারতেন এবং বাড়িতে সকল দেবদেবীর নাম সংরক্ষণ করতেন। তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গারোদের ওয়ানগালা অনুষ্ঠানে খামালের দায়িত্ব পালন করেছেন। গারো অঞ্চলের প্রায় শতভাগ এলাকায় গারোদের আদি সংসারেক ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হলেও তিনি তার পরিবারে একাই আদি বিশ্বাসকে আমৃত্যু লালন ও ধারণ করে পালন করেছেন। এই গারো সমাজ, সংস্কৃতি ও আদি ধর্ম লালন, ধারণ ও সংরক্ষণকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও গবেষকগণ গবেষণা বিষয় করে অনেক বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি নিজে আদি গারো সাংসারেক ধর্মকে যক্ষের ধনের মতোন লালন ও ধারণ করে গেছেন শতবছর।

জনিক নকরেক গারো জনগোষ্ঠীর শুধুমাত্র সাংসারেক খামাল হিসেবে নয়; তিনি সাংসারেক ধর্মের কিংবদন্তি, এবং স্বাক্ষী হয়ে থাকবেন। গারোদের বিশ্বাস; শরীরের মাঝে আত্মা বাস করে। মৃত্যুর ফলে আত্মা শরীর ছেড়ে মাংরু এবং মাংরাম নামক স্থানে চলে যায়। মাংরু এবং মাংরাম হল আত্মার ভালো-মন্দের বিচারের স্থান। যতদিন না পুনর্জন্ম হয় ততদিন আত্মা সেখানে স্থায়ী হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তাদের মতে মৃত্যুর কারণ অনুযায়ী আত্মার পরিণতি ঘটে। আমার বিশ্বাস জনিক নকরেক এর দেহের মৃত্যু হয়েছে কেবল; কিন্ত তার রেখে যাওয়া সাংসারেক ধর্মের সুসমাচার নতুন প্রজন্মের কাছে পৌচ্ছুবে, পৌচ্ছুবে-ই আজ অথবা কাল। (তথ্য ‍সূত্র: দ্যা বিউটি অব গারোজ, অপ্রকাশিতব্য)

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স
ওয়েভপেজ ডেভেলপার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার, ব্লগার এবং
সাহিত্য কর্মী  lchiran76@gmail.com