মধুপুরের শালবনে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়ে যেন থাকা নিয়ে পর্যটকদের (আসলে উচ্চবিলাসীদের) কোন ধরণের অসুবিধায় পড়তে না হয় সেজন্যে দোখলায় চার তলা বিশিষ্ট রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে যারা ঘুরতে যাবে তাদের বাড়তি খেদমত স্বরূপ ধানী জমিতে লেক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যাতে তারা আনন্দ— মন ফ্রেশ করার সুযোগ পায়। যেহেতু শুরু থেকেই আদিবাসীরা লেক নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল সেহেতু ‘হাওয়া বুঝতে’ স্থানীয় এমপি কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গত শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) নৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য আদিবাসী নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন। কিন্তু নেতৃবৃন্দ সমর্থন না দিলে মন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।
রেস্ট হাউজ ও লেক নির্মাণের নেপথ্যে কি লুকিয়ে আছে তা জানতে হলে ‘আগ্রহ-ব্যক্তকরণ বিজ্ঞপ্তি নং- ০১/২০১৮-২০১৯’ দেখতে হবে। টাঙ্গাইল বনবিভাগ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে ‘স্থানীয় ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণের সহায়তায় মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য কনসাল্টিং ফার্ম নিয়োগের লক্ষ্যে আগ্রহ-ব্যক্তকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে। এমন সময়ে এই টেন্ডার আহ্বান করা হয় যখন গারোরা সচরাচর বড়দিন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্যকিছুতে মনোনিবেশ করার ফুরসত মেলে না।
সেই বিজ্ঞপ্তিতে— দ্বিতল বিশিষ্ট নতুন রেস্ট হাউজ নির্মাণ, কানেকটিক রোড নির্মাণ, সারফেস রোড নির্মাণ, পানি সংযোগ, ভূ-গর্ভস্থ জলাদার নির্মাণ, পানির পাম্প বসানো, সীমানা প্রাচীর’সহ আরবোরটাম নির্মাণ, সেপটি বাউন্ডারী ওয়াল (গেটসহ) নির্মাণ, এইচবিধি রাস্তা ও স্টাফ ব্যারাক নির্মাণ, পার্কিং এরিয়া নির্মাণ, টয়লেট নির্মাণ, আরসিসি সিটিং বেঞ্চ ইত্যাদি নির্মাণের কথা জানানো হয়। মোট কথা ইকোপার্কের আবডালে ইকো-ট্যুরিজম নির্মাণ সরকারের বনবিভাগের মূল লক্ষ্য আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকেই তারা হাঁটছে এবং ইতোমধ্যে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।
দোখলায় রেস্ট হাউজ কিংবা টেলকীর মাংরুদামে (আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী শ্মশান ভূমি) আরবোরাটামের নামে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কি সেটিই জানান দেয় না? ধীর গতিতে হলেও ইকো-ট্যুরিজমের কাজ চলছে— এটি বোঝার আর বাকি থাকে না। স্থানীয় জনগণের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও জীবন প্রকৃতি বিনাশী এইসব প্রকল্প কেন বাস্তবায়ন করতে হবে? গৃহীত প্রকল্পের চেয়ে জীবনের মূল্য অবশ্যই বেশি। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হবে, লেক নির্মাণ করা হলে কৃষকেরা হারাবে ধানী জমি, বনবাসী হারাবে বনে চলাফেরার অবাধ স্বাধীনতা, বিপদাপন্ন প্রকৃতি হারাবে নিজস্ব রূপ-স্বতন্ত্রতা।
ধানী জমি নষ্ট করে লেক কেন করা লাগবে— এমন প্রশ্ন তুললে প্রসঙ্গক্রমে সরকারের উন্নয়ন নীতির কঠোর সমালোচনা করতে হয়। সকারের সব উন্নয়ন যে প্রান্তিক মানুষদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না বরং গলার কাটা হয়ে বিধেঁ থাকে সেটি বোঝাতে দুই মেরুর অধিবাসীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক মেরুর বাসিন্দা ইংরেজী ৯ সংখ্যাকে যেভাবে দেখবে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা সেই ৯ সংখ্যাকে উল্টো ৬ দেখবে। দেখার দৃষ্টি ও অবস্থানগত কারণে একই জিনিস ভিন্ন হয়। সেই ভিন্নতায় কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেটি অবশ্যই গুরুত্বের— মূল্যায়নের দাবি রাখে। সেদিকে রাষ্ট্রকে কড়া নজর রাখতে হয়।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আদিবাসীরা জমি, ভিটে-বসত, বাগান, শ্মশানভূমি হারিয়েছে— এমন বহু নজির আছে। আমরা খালিচোখে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবলোকন করি কিন্তু সেই উন্নয়নের আড়ালের তমসা দেখি না। তথাকথিত উন্নয়নের বাতির নিচে যে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অজস্র মানুষের কান্না লুকিয়ে থাকে সেটি সামনে আসে না; অন্ধকারে থেকে যায়। অনালোকিত সেই অন্ধকূপে টর্চ লাইট জ্বালালে পাওয়া যাবে আদিবাসীদের ভূমি হারানোর তিক্ত অসংখ্য গল্প। এইসব গল্প মধুপুরের সচেতন আদিবাসীদের আরো হরিণের মতোই সদা সজাগ রাখবে বলে মনে করি।
আরেকটি কথা তুলে ধরা দরকার। এটা আওয়ামী সরকারের কৌশলও বলা যেতে পারে। যেকোন বড় প্রকল্প কিংবা স্থাপনা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবার স্বজনের নামে বাস্তবায়ন করা, যাতে করে কেউ ওই উন্নয়ন স্থাপনার বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে না পারে। যারা প্রশ্ন তুলবে তাদেরকে অতি সহজেই জামাত শিবিরের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া যায় এমনটা আমরা আগেও দেখেছি। দোখলার সেদিনের বৈঠকেও বঙ্গবন্ধুকে টেনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে— ‘১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সপরিবারে দোখলাতে এসেছিলেন। এই কারণে দোখলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সেই ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে আনা দরকার।’ অবশ্যই আনা দরকার। কিন্তু লেক নির্মাণ করে স্মৃতি ধরে রাখতে হবে কেন? স্মৃতি ধরে রাখতে লেক একমাত্র যথোপযুক্ত পন্থা নয়।
স্মৃতির কথা যখন বলা হচ্ছে তখন সেইসময় (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু যে দোখলায় বনবাসী আদিবাসী মানুষের অধিকার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটিও আমাদের সমানভাবে বলতে হবে। ইতিহাসের খণ্ডাংশ পাঠ সবসময়ই বিপত্তি ঘটায় এটি ভুললে চলবে না। তিনি দোখলায় আদিবাসী মানুষের প্রথাগত ভূমির অধিকার প্রদানের কথা বলেছিলেন— অথচ বনবাসী এখনো অধিকারহীন। বঙ্গবন্ধু যে মাপের আদর্শিক নেতা তাকে, তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে, দুঃখী মানুষের দুঃখকে লেক নির্মাণ করে দূর করা যাবে না। বরং এটি আরো দুঃখ বাড়াবে।
বঙ্গবন্ধু দোখলায় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটি বাস্তবায়ন করা আওয়ামী সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সেই জেরে অচিরেই আদিবাসী বনবাসী মানুষের প্রথাগত ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার পুনঃ দাবি জানাই।

তরুণ লেখক: উন্নয়ন ডি. শিরা, দর্শন বিভাগ,

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।