আ.বিমা টাইমস নিউজ, মধুপুর: টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় টেলকীতে আদিবাসীদের ভূমি ও কবরস্থানে ইকো-ট্যুরিজম স্থাপনা নির্মাণ, মধুপুর গড়াঞ্চলে বন উন্নয়নের নামে প্রাচীন গাছ উজার করে সেখানকার বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় গেস্ট হাউজ ও প্রাচীর নির্মাণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
আজ রবিবার (৩০ মে ২০২১) সকাল ১১টায় টেলকী বাস স্ট্যান্ড ও বাজারের টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর ‘মধুপুরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে পুলিশের বাঁধা উপপেক্ষা করে বিক্ষোভ সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়।
বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন ছাত্রনেতা জেএসএফ এর সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিলে এবং সভাপতিত্ব করেন বাগাছাস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জন জেত্রা।
সমাবেশের সূচনা ও মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন লিয়াং রিছিল। এ সময় তিনি বলেন, তৎকালীন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামল পেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা ও ভূমির মালিকানার স্থায়ী সমাধান করা হয় নি। বরং আদিবাসীদের সঙ্গে কোনরকম আলাপ আলোচনা না করে এবং স্থানীয় আদিবাসীদের সকল দাবি উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন সরকার জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক, ইকো ট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের নীল নকশা ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে এবং এখনো বনবিভাগ পায়তারা করছে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এদিকে সভাপতির বক্তব্যে জন জেত্রা বলেন (বাগাছাস কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি), শশ্মান আদিবাসীদের জন্য পবিত্র স্থান। এই স্থানে বনবিভাগ গায়ের জোর দেখিয়ে যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে তাহলে মধুপুরের আদিবাসী ছাত্র-জনতা বসে থাকবে না। এছাড়া প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে যদি বিদেশি ও কৃত্রিম বন সৃজন করতে চান তাহলে আদিবাসীরা অতীতে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তেমনি আগামীতেও রুখে দাঁড়াবে বলে তিনি জানান।
সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান বলেন (বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম), টাঙ্গাইল জেলার বন বিভাগ কর্তৃক যে প্রকল্পগুলো আদিবাসী এলাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেগুলো বনবিভাগে গায়ের জোড়ে এবং এলাকার আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করার জন্যেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব প্রকল্প, বন উন্নয়নের নামে বনবিভাগ যদি আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ না করে তাহলে আগামী দিনে আদিবাসী ছাত্র জনতা যেকোন মূল্যে তা প্রতিহত করবে বলে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
এছাড়াও সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ বলেন (বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ), বন বিভাগ এই টেলকী গ্রামের পূর্ব পুরুষদের পবিত্র শশ্মান ভূমির উপর প্রকল্প নিয়ে বন রক্ষার বদলে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে যে কৃত্রিম বন সৃজন করছে তা আদিবাসী এবং জন বান্ধব নয়। এভাবে যদি প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা হয় তাহলে ভারতের নাগরিকদের মতোন একদিন অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে হবে। আমরা বন বিভাগের বিপক্ষে নয়। কিন্তু বন বিভাগ যেভাবে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা বন মামলায় হয়রানি করছে সেটা দেশের সরকার বনবিভাগকে আদিবাসীদের বিপক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে অনতি বিলম্বে এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ টেলকীর প্রাচীন শশ্মান ভূমিতে প্রাচীর ও সকল প্রকল্পের অন্যান্য স্থাপনা বন্ধ করার জোর দাবী জানান এই আদিবাসী ছাত্র নেতা।
সভাপতি প্রলয় নকরেক বলেন (জিএসএফের কেন্দ্রীয়), সরকার উন্নয়নের নামে যে প্রকল্পগুলো আদিবাসী অঞ্চলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে সেগুলো প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের নামে কৃত্রিম বন সৃজন করে স্থানীয় আদিবাসীদের জন জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেন তিনি।
গৌতম কর বলেন (সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য), যখন উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে সেখানে উন্নয়নের বিপরীতে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমরা লক্ষ্য করছি। উন্নয়নের নামে পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতিবাদ আন্দোলন সত্ত্বেও উচ্ছেদ ও সেখানে পর্যটন স্থাপনা চলছে। আদিবাসী অঞ্চলে বিভিন্ন উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের অধিকার হরণ ও শশ্মানের মতোন পবিত্র স্থানের উপরও তাদের পরিকল্পিত আগ্রাসন বলে তিনি উল্লেখ করেন এই ছাত্র নেতা।
বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সভাপতি অনন্ত বিকাশ ধামায়, আজিয়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মানকিন এবং নারী নেত্রী লিজা নকরেক প্রমূখ বক্তারা তাদের বক্তব্যে বলেন, কেন আদিবাসী অঞ্চলে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকল্প এনে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে প্রাচীর নির্মাণ ও স্থাপনা তৈরি তা জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। কেন বিভিন্ন সময় বনবিভাগ অপরিকল্পিত, পরিবেশ আগ্রাসী ও বন বিনাশী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে ইত্যাদি বিষয়ে সরকার ও বন বিভাগের কাছে প্রশ্ন তোলেন এসব নেতারা।
এছাড়াও উক্ত সমাবেশ থেকে চার দফা দাবীনামাও উত্থাপন করেন ছাত্র নেতারা। উক্ত দাবীগুলো যেমন- টেলকী গ্রামে তথাকথিত আরবোরেটামের নামে আদিবাসীদের শশ্মান এর স্থানে প্রাচীর নির্মান ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে বন্ধ করা, আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় কৃষি ও ফসলি জমিতে কোনো ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা, জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বন ভূমি ঘোষণা বাতিল করে আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ করা এবং আদিবাসী প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।
উক্ত বিক্ষোভ ও সমাবেশে বক্তারা সাত দিনের আল্টিমেটাম ঘোষণা দেন। এই সাত দিনের মধ্যে যদি প্রকল্পের কাজ বন্ধ করা না হয় তাহলে মধুপুরের আদিবাসী ছাত্র-যুব-জনতা আরো কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন নেতারা।
সমাবেশ শেষে মিছিল বের করতে চাইলে আদিবাসী নেতারা পুলিশের বাঁধার মুখে পড়েন। পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে সমাবেশের মিছিলটি টেলকী বাজার পেরিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক প্রদক্ষিণ করেন।
বিক্ষোভ সমাবেশে দুই শতাধিকের বেশি আদিবাসী ছাত্র, আদিবাসী ছাত্র সংগঠন, গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী নারী পুরুষ এতে অংশগ্রহণ এবং সংহতি প্রকাশ করেন।