পৃথিবীতে কিছু মানুষ অন্ধকারেও আলো দেখে। শোষণ বঞ্চনার মধ্যেও এক চিলতে সুখ খোঁজে পায়। আশা-নিরাশার দোলাচলেও স্বপ্নকে আঁকরে ধরে। বাঁচার খুঁটি খুঁজে নেয়। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আর রাশি রাশি আলো প্রাপ্তির ঠিক এমন বোধ থেকেই অনেক উদ্যোক্তার জন্ম হয়। তাইতো ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম বলেন- ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরনের প্রত্যাশা, মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।‘

কোভিড ১৯ আমাদের অনেক কেড়ে নিয়েছে ঠিকই; সেই সাথে ভালো কিছু করার স্বপ্ন এবং সুন্দর আগামীর পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন ছোট থেকে বড় হওয়ার স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দেবে আপনারই নিপুন হাতে।

ফেসবুক উদ্যোক্তা এবং জয় ফেশ্যান হাউজের প্রতিষ্ঠাতা সোনা আলো চাকমা বলছিলেন- ‘আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ড লিস্টে ফ্রেন্ড খুবই কম ছিলো। মনে মনে ভাবতাম কিভাবে আমার প্রোডাক্টগুলো সেল করবো। কিভাবেইবা পেজে বিজ্ঞাপন দেবো। আমি যে প্রোডাক্টগুলো সেল করবো কাস্টমার কিভাবে জানবে ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রথমে একেবারে বুঝতাম না। এসব ভাবতেই মাথা এলোমেলো হয়ে যেতো।

প্রায় এক বছর যাবত লক্ষ্য করছি, এবং কোভিড ১৯ শুরু পর থেকে ঘরে বসে আরও বেশি আমি লক্ষ্য করলাম যে অনেকেই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বাসায় রান্না করা খাবার, পোষাক পরিচ্ছদ, এবং কারুপণ্যও বিক্রি করছে, যা আমার কাছে খুব সময়োপযোগী ও ভালো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা বলে মনে হয়েছিল। তাই ফেসবুক পেজের মাধ্যমে যারা বাসায় রান্না করা খাবার বিক্রি করছে, বাহারী পোষাক বিক্রি অথবা কারুপণ্য বিক্রি করছে আমি সেই পেজগুলো বেশি সার্চ করতাম এবং তাদের ব্যবসার ধরণ বোঝার জন্য সেই পেজগুলোকে অনুসরণ করতাম। পেজগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে নিয়মিত দেখতাম। এসব দেখতে দেখতেই বাসায় আদিবাসীদের তাঁতেবুনা পোষাক এবং অন্যান্য কারুপণ্য অন লাইনে বিক্রি করে আয়ের আইডিয়াটি মাথায় চলে আসে।

তাছাড়াও আমি দেখলাম, দু’জনের চাকরীর পয়সায় মাস শেষে পরিবার সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কোভিড ১৯ কারণে আরো পুরো পরিবারের খরচ চালানো দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। তাই আমার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে চাকরীর পাশাপাশি তাকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিই, যাতে আমাদের পরিবার একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারি।

 

অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে দু’তিন মাস আগে ফেসবুক পেজ খুলেছিলাম। মূলত আদিবাসী চাকমাদের ব্যবহৃত পোষাকের ছবি দিয়ে একটি ফেসবুক পেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিই। বিভিন্ন পণ্যের ছবিগুলো ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেও শেয়ার করতে থাকি।‘

আলো চাকমার পণ্য সামগ্রীগুলো মূলত সবই ট্রেডিশনাল বিশেষ করে আদিবাসীদের ব্যবহৃত চাকমাদের ট্রেডিশনাল পণ্য যেমন- ট্রেডিশনাল ড্রেশ থামি, হাদি, পিনন, ওড়না, কুটি এবং এ ছাড়াও বার্মিজ লুঙ্গি, গামছা, মাহিলাদের ব্যবহৃত কাপড় চোপড়, ছেলেদের জন্য ব্রান্ডের টি শার্ট, শর্ট পেন্ট ইত্যাদি। খুবই কোয়ালিটি সম্পন্ন পণ্য বলা যায়। গ্রামের দক্ষ কারিগর দিয়ে তৈরী কাপড়-চোপড় তদারকি করে সেগুলো সংগ্রহ ও কোয়ালিটি মেইনটেইন করেন। সফলভাবে যাতে গ্রাহকদের কাছে পণ্যগুলো পৌঁছে যায়; এবং তার সেবায় গ্রাহক সন্তোষ্টি যেন সহজে আসে।

কিভাবে প্রথম অর্ডার পেলেন এবং প্রথম অর্ডার পাওয়ার অনুভূতি কেমন? সোনা আলো চাকমা বলেন- ‘প্রথমে আমার পেজ আইডিতে প্রোডাক্টগুলো আপলোড দিই। আমার পরিচিতরা প্রোডাক্টগুলো দেখে সেল ফোনে যাচাই করতে শুরু করে। এরপর সেল ফোনে প্রথম অর্ডারটি করে এবং তাদের বাসায় গিয়ে নিজ হাতে পণ্যগুলো ডেলিভারি দিয়ে আসি। এইভাবে সেল করতেই হঠাৎ সিলেট থেকে আরেকজন পিনন-হাদির কথা জিজ্ঞাসা করে। প্রোডাক্টগুলোর ডিটেলস বর্ণনা দিই।

এভাবে বেশ কিছুদিন রেগুলার ফেসবুজ পেজে ছবিগুলো পোস্ট করতে থাকি। এর কিছুদিন পরেই আলো তার প্রথম অর্ডারটি পান। অর্ডারটি পান নিজেদের এলাকা থেকে। একসাথে বেশ কয়েকজনে পিনন-হাদি কিনেছিল। রিভিউটাও ভালো ছিল। সেল ফোনে রিভিউ দিয়েছিলেন। তবে সিলেটের রিভিউটা সবচাইতে ভালো লেগেছিল। এক মারমা মেয়ে কিনেছিলেন পিনন-হাদি। পণ্যটি হাতে পাওয়ার পর সাথে সাথে নিজে ড্রেসটা পরে একটি চমৎকার ফটোসহ ভালো রিভিউ পাঠিয়েছেন। আমি আজও সেই দিনের কথা মনে করি।

এভাবে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গায় থেকেও ফেবু ম্যাসেঞ্জারে নক করতে থাকে। প্রথম প্রথম  মেসেঞ্জারে কাস্টমার কিছু জিজ্ঞেস করলে রিপ্লাই করতে কষ্ট হতো। দ্বিধা বোধ করতাম। একজন অচেনা অজানা লোকের সঙ্গে চ্যাট করা বা কথা বলতে সংকোচবোধ করতাম। কারণ ফেসবুকে ভালো মানুষ এবং খারাপ মানুষও থাকে। অবশ্য সে ধারণাটা আমার খুবই কম ছিল। এইরকম করতে করতে প্রায় একমাস সাতাশ দিন কেটে গেছে। এখন একটু একটু বুঝতেছি। আসলে যারা রিয়েল কাস্টমার তারা শুধু প্রোডাক্টগুলো জিজ্ঞেস করে সাথে সাথেই কন্ট্রাক্ট করে নেয়; আর যারা বাজে গ্রাহক তারা আজেবাজে কথা বলে সময় নষ্ট করে।

প্রথম অর্ডারটি পাওয়ার পর আমি আমার স্বামীকে ফেসবুক পেজটি সম্পর্কে বলি। প্রথমে তিনি অবাক হন এবং একই সঙ্গে বেশ খুশিও হন। তাদের পছন্দের পণ্য পাঠাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং উৎসাহিতবোধ করি। সে দিনটি আসলেই ভুলার নয়। কারণ অর্ডারগুলো তারা অনলাইনে করেছিলেন। এভাবেই আমি প্রথম অর্ডারটি আমাদের গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এবং অদ্যাবধি ফেসবুকের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।‘

এভাবে ফেসবুকে প্রায় দু’তিন মাস কেটে গেছে। ফেসবুক উদ্যোক্তা আলো আরও জানান, ‘সত্যি কথা বলতে শুধু আমাদের আদিবাসীরা নয়, বাঙ্গালীরাও এসব পণ্য সামগ্রী কিনে। পণ্যগুলো হাতে পাওয়ার পর গ্রাহকগণের পজিটিভ ফিডব্যাক পেলে দুর্দান্ত উৎসাহ জাগে। নেগেটিভ ফিডব্যাক পেলেও মন খারাপ করি না, বরং নিজের ওপর যত্নের তাগিদ অনুভব করি। নিজের ভুলগুলো শুধরে কাজ করি। তবে এ পর্যন্ত আসার পেছনে আমার গ্রাহক ও অনুরাগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এছাড়াও যারা আমাকে প্রতিনিয়ত সাহজ ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিও বিনম্র শ্রদ্ধা। ফেসবুকসহ অন লাইন উদ্যোক্তা সম্পর্কে এখনো জ্ঞান নিচ্ছি, জানার কোন বিকল্প নেই। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও করে যাবো গ্রাহকদের গুণগত প্রোডাক্ট এবং মান সম্পন্ন সেবা দিতে।‘

আমরা যারা সোস্যাল মিডিয়াতে সময়, মেধা এবং অর্থ অপচয় করছি সোনা আলো চাকমার এমন বাস্তব অভিজ্ঞতা বোধ করি আমাদের সকলের কাজে দিবে। আলো চাকমার মতোন আলোকিত নতুন উদ্যোক্তা আরও গড়ে উঠুক। স্বনির্ভর এবং আত্মনির্ভশীল হয়ে উঠুক সকল নারী সমাজ।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার
এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।