“জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”

কবি সাত্যিকদের কথাগুলো মিথ্যে নয়! জাগতিকভাবে এর প্রমাণ রেখে গিয়েছেন ডাঃ এড্রিক বেকার; এলাকায় যাকে সবাই বেকার ভাই হিসেবে জানে। আজ মানবতার এক মুক্তিদূত ডাক্তার বেকার ভাই  (ডাঃ এড্রিক বেকার) এর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন বাংলাদেশে সূদুর নিউজিল্যান্ডের ভোগবিলাসিতা ভুলে ডাঃ এড্রিক বেকার ১৯৭৬ সালে আসেন। যিনি ছোট বেলা থেকেই দরিদ্র অসহায় লোকদের মাঝে সেবাধর্মী কাজ করার দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন। মানুষের জন্যই মানুষ- তার জ্বলন্ত প্রমাণ রেখেছেন ডাঃ এড্রিক বেকার; মানবতার এক মুক্তিদূত ডাক্তার বেকার ভাই। মানবতার কল্যাণে নিজের দেশ সুদূর নিউজিল্যান্ড ছেড়ে প্রায় ৩৬ বছর যাবত বাংলাদেশের নিভৃত পল্লিতে থেকে দেশের আর্তমানবতার সেবা করে গেছেন। মহান এ মানুষটিকে হানিফ সংকেত তাঁর ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলার মানুষের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন থেকে আদিবাসী অ-আদিবাসী সকলের কাছেই তিনি অতি আপনজন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী ও শিক্ষা জীবন : জন্ম নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিন্টনে ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে। ডুনেডিন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস (১৯৬৫ সালে)  পাস করার পরে ওয়েলিন্টনে ইন্টার্নি শেষে তিনি নিউজিল্যান্ড সার্জিকাল দলের সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন এবং সেখানে  ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর ‘৬৫ এবং ‘৭৫ এর মাঝে অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, গাইনি ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে। কোর্সচলাকালীন সময় সেবা দিয়ে সেখানে লক্ষ্য করেন তিনি; অনেক জটিল রোগীদের  যুদ্ধে বুলেট বা বোমার আঘাতে আহত যে সৈনিকেরা চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠে; অথচ একই রোগী কয়েকমাস পর ডায়রিয়া, কলেরা এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এমন ব্যতিক্রম বিষয় তাঁকে একটু ভাবিয়ে তোলেন। এরপর সে বিষয়টাকে নিয়ে ডাঃ বেকার গভীরভাবে ভাবলেন, একটু সচেতন হলেই এই মৃত্যুটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সেখানে কাজ করার সময়ই তিনি পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের দুর্ভোগের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় গিয়েও কোথাও তার মন টেকেনি। আবার এরই মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে যান যুক্তরাজ্যে।

পড়াশুনা শেষ করে ডাঃ বেকার বেশ কিছু দেশ ঘুরে দেখেন। এরপর ১৯৭৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে এক সপ্তাহের জন্য আসেন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে তিনি বাছাই করে নিয়েছেন এমন একটা জায়গা, যেখানে তিনি প্রকৃত অর্থে অসহায় মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন, প্রকৃত মানব সেবা দিতে পারেন। তাই পুনরায় ১৯৭৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে বাংলাদেশে চলে আসেন।

বাংলাদেশে এসে  প্রায় দু’বছর মেহেরপুর মিশন হাসপাতাল এবং পরে কুমুদিনী হাসপাতালে আট মাস কাজ করেন।  তার ইচ্ছে ছিল বড় হাসপাতালে কাজ না করে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কাজ করার।  প্রথমে গারো গ্রাম থানারবাইদ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং পরে কালিয়াকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আশপাশের প্রায় ১৭টি গ্রামে হাসপাতালের পক্ষ থেকে গর্ভবতী মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা, যক্ষা, কলেরা, ডায়াবেটিক ইত্যাদি রোগের চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রাথমিক চিকিৎসার সাথে রোগ প্রতিরোধ নিয়ে বহু সচেতনতা প্রদানের কর্ম পরিচালনা করেছেন। শুধু ক্লিনিকেই নয়, কোনো রোগী চিকিৎসাকেন্দ্রে আসতে না পারলে, দু-একজন সহকর্মীসহ সাইকেল চালিয়ে ডাক্তার ভাই নিজেই বেরিয়ে পড়তেন তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে।

 

ডাঃ বেকার প্রায়ই নিজে থেকে বলতেন, ‘আমি, আমার অন্তর পড়ে আছে এই দেশে। এই দেশের মানুষের সাথে থাকতে পেরে আমার জীবন স্বার্থক। নিজের দেশকেই এখন বিদেশ মনে হয়!’ শুধু তাই নয়; ডাঃ বেকার  মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যু যেন বাংলাদেশের মাটিতেই হয়। এবং মৃত্যুর পর তাঁকে দাফন যেন হয় কালিয়াকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।

দু:খি মানুষের সেবা কাজে ৩৬টি বছর, তাঁর জীবনের অনেকটা সময়। মানুষকে কতটা ভালোবাসলে স্বদেশ, আত্মীয়পরিজন ছেড়ে বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর, অসহায় মানুষের সাথে থাকা যায়, তাঁকে নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি সদা হাসিখুশি এবং মাটির মানুষ। ডাঃ এড্রিক বেকার, বিদেশী মানুষ হয়েও মাটির বিছানায় ঘুমাতেন, আজীবন মাটিতে বসে রুগীকে চিকিৎসা সেবা দিতেন।

৭৬ বছর বয়সে হার্টের রোগে ভুগছিলেন। তিনি খরচের কথা ভেবে বড় কোন হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে রাজি হননি; দরিদ্র অসহায় মানুষদের কথা ভেবে অবসরে যাওয়ার কথাও তিনি ভাবতেন না। ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর আজকের এই দিনে সবাইকে কাঁদিয়ে, তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এবং ২রা সেপ্টেম্বর তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে রোজ বুধবার দুপুর বেলা কালিয়াকুড়ি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার
এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।