যে নদীর রুপ যৌবন ঈশ্বর নিজেও হয়তো বুঝে না, যে নদীটি বর্ষায় থাকে অবাক এক প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা, সমুদ্রের যোগ্য সহচারী, রাক্ষুসী, ভয়াল, উত্তাল, আগ্রাসী ও স্রোতস্বিনী; সে নদীতে ভাঙ্গনরোধে বাঁধভাঙ্গা আওয়াজের পর নির্মাণ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন এক এলাকাবাসী। খুবই আনন্দের বিষয়, প্রশংসার দাবি রাখে ! অন্যদিকে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, যে নদী ভারতের ভৌগোলিক মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় পাষাণ বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে এক শান্ত ছোট্ট মরা খালে পরিণত হয়ে আছে। আবার সেই নদীটি ভারতে পাহাড়ি ঢলে এবং বর্ষা মৌসুমে বিধ্বংসী সাগর কন্যা হতে কতক্ষণ!

সোমেশ্বরী নদী পাড় ভাঙ্গন প্রকল্পের একাংশ চিত্র

গেল বছর করোনায় নিমজ্জিত এবং সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সোমেশ্বরী পাড় ভাঙ্গে। নির্ঘুম কাটিয়েছে নদী পাড়ের সকল মানুষ। তাদের চিন্তা চোখের পলকে কখন, কার বাড়ি ধ্বসে পড়ে, কার ভিটা ভেঙে তলিয়ে যায় নদী গর্ভে! নদীর এমন বিধ্বংসী প্রকোপটি কামারখালি গ্রামে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা ছিল। একদিকে করোনার করালগ্রাসে জর্জরিত; অন্যদিকে এলাকায় অন্তহীন নদী ভাঙ্গন। এ যেন মরার উপর খরার ঘা। এলাকার যুবকরা দিনরাত জেগে পাহারা দিয়েছে। তখন দৃশ্যত মনে হয়েছিল ঢাল নেই, তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার, পাহারা দিয়েইবা কি হয়েছে! পাহারাদারদের তীক্ষ্ন চোখ ফাঁকি দিয়ে পেশাদার চুরের মতোন সিঁদ কেটে নদীর বিধ্বংসী ঢেউ ঘরে প্রবেশ করে মালামাল সাবাড় করেছে, ভিটে বাড়ি তছনছ করেছে নিমিষেই, নদীর সেই রাক্ষসী ছোবল এলাকাবাসী আজও ভুলে নি !

এহেন উল্লেখ্য, সিমসাং নদীর করাল থাবা থেকে রক্ষার জন্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে কারিতাস ময়মনসিংহের উদ্যোগে দূর্গাপুর সার্বিক মানব উন্নয়ন সংগঠন রাণীখং থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত নদীর পশ্চিম পাড়ে সিসি ব্লক বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করে। দুই তিন বছর গণসংযোগ ও সভা মিটিং করে স্মারকলিপি প্রদানসহ স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে এডভোকেসি হয় অনেকবার। অতপর সরকার ২০০৮ খিস্টাব্দে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সিমসাং-এর পশ্চিম পাড়ে সিসি ব্লক নির্মাণের জন্য ২৫ কোটি টাকা মঞ্জুর করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সিসি ব্লক বাঁধ নির্মাণ হয় ডাকুমারা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত। বাদ পড়ে যায় উজানে ভাঙ্গন প্রবন গারো অধ্যুষিত গ্রাম রাণীখং, কামারখালি, বড়ইকান্দি ও ভুলিপাড়া। যেখানে পাহাড়ের পানি প্রথমে ধাক্কা লাগে। এ গ্রামগুলো এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়।

গত বছর তীব্র ভাঙ্গনের ফলে সে নদীর ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী সমাধান কল্পে সোস্যাল মিডিয়ায় গণদাবিতে পরিনত হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলাকাবাসী জানান, এ বছর জানুয়ারি মাসে উক্ত এলাকাগুলোতে ভাঙ্গনরোধ প্রকল্পে প্রায় ১১ কোটি টাকার সেংশ্যান হয়েছে। প্রকল্পের কাজ জানুয়ারী থেকে শুরুর কথা থাকলে তারা কাজ শুরু করে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে। নির্ধারিত প্রকল্প মতে, পাঁচটা স্থানে কাজ হবে, যেমন ভবানিপুর (বটগাছ), কামারখালি উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়া, বড়ইকান্দি, শিবগঞ্জ, এবং গাওকাইন্দা৷  তম্মমধ্যে তিনটা স্থানের কাজ- শিবগঞ্জ, বড়ইকান্দি, এবং কামারখালির দক্ষিণ পাশে কাজ শুরু হয়েছে ধীর গতিতে।

এমতাবস্থায় এলাকাবাসীর মতে, বর্ষা মৌসুম আসন্ন! এভাবে কাজ যদি ধীরগতিতে চলে তাহলে বন্যার কবলে আবারও পরে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে প্রবল বৃষ্টি আর নদীর পানি কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় এলাকাবাসীর মনে রীতিমত আবার আতঙ্ক তৈরি করে দিচ্ছে। ভরাট করা বালুর বস্তাগুলো নদীতে ডুবে যাচ্ছে, কাজের তেমন অগ্রগতি, প্রকল্প দেখভালের কেউ নেই !

ঐ এলাকার এক এলাকাবাসী জানালেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে দ্রুত কাজ শেষ করার আশ্বাসবাণী দেওয়া হলেও কাজের গতি আবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে এলাকাবাসীকে। এলাকাবাসীর দাবি ছিল নদী পাড়গুলো সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণের। কিন্ত তানা করে বস্তায় বালু ফেলে যাও করছে তৈড়িৎ গতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করলে খুব শীঘ্রই নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়বে। ফলে এলাকাবাসীর একই প্রশ্ন যে, পানি উন্নয়নবোর্ড কাজ শুরু হয়েছে; আদৌ সেটি আলোর মুখ দেখবে কী? নাকি বিগত দিনের মতোন রাজনীতির ঘেরাকলে আটকে যাবে সোমেশ্বরী নদী পাড়ের মানুষের ভাগ্য ?

বর্ষা মৌসুম আসার আগেই পানি উন্নয়নবোর্ড বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে অনতিবিলম্বে কাজগুলো দেখভালসহ নদী ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা করে সোমেশ্বরী নদী পাড়ের মানুষের প্রাচীন বাস্তুভিটে এবং সম্পত্তি রক্ষায় দ্রুত এগিয়ে আসা উচিত নয় কী?