নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভাল নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি জবরদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি দখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ আয়োজিত অনলাইন আলোচনাসভায় সন্তু লারমার পাঠানো বার্তাটি পাঠ করে শোনান আদিবাসী ফোরাম’র কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেন প্রমীলা।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি অজয় মৃ এর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল আলোচনায় আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ছাড়াও যুক্ত ছিলেন দেশবরেণ্য বিশিষ্টজনেরা। সোমবার সকাল ১১টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আলোচনা সভা। আলোচনাসভাটি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ফেসবুক পেইজে সরাসরি সম্প্রচার হয়।

আজ ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এ বছরের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য :  ‘Leaving No One Behind: Indigenous peoples and the call for a new social contract.’ বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম যার বাংলা রুপ করেছে ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়: আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহবান’ ।বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম 2021

আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ২০২১, ভার্চুয়াল আয়োজনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম 

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯০টি দেশের ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী ও সকল মুক্তিকামী মানুষকে আদিবাসী দিবসের  শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে সন্তু লারমা বলেন, “এ দিবসটি আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নব চেতনায় উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। বিশেষ অনুপ্রেরণার দিন।

তিনি বলেন, “এই করোনাকালে আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। সুচিকিৎসার অভাবসহ লকডাউনের কারণে নানা অর্থনৈতিক সংকটে এই প্রান্তিক মানুষেরা দুর্বিষহ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।”

বিগত ২৩ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয় নি অভিযোগ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’র চেয়ারম্যান সন্তু লারমা বলেন, “বর্তমানে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম বন্ধ রেখে চলেছে।  বহুবার দাবি তুলে ধরা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময় সূচি ভিত্তিক কার্যকর পরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করা হয় নি। পক্ষান্তরে অপারেশন উত্তরণ নামক সেনা কর্তৃত্ব পার্বত্য অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করা হয় নি। সমতলের আদিবাসীদের জন্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করে নি। আজ আদিবাসী দিবসে আমি সরকারের প্রতি এইসব অঙ্গীকার পুরণের আহ্বান জানাই।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীণ বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। দু:খজনক যে আমাদের দেশে কখনো কখনো দেখা যায় আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বৈচিত্র্যকে আমরা স্বীকার করছি না, হেয় করে দেখছি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড: সাদেকা হালিম বলেন, শোকাবহ আগস্টে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বারবার আদিবাসীদের স্বীকৃতি, বহুত্বের স্বীকৃতি।, স্বশাসনের স্বীকৃতির দাবী তুলেছিলেন। তাঁর সকল দাবী হয়তো এখনো পূরণ হয় নি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি ধারাবাহিকভাবে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।

আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহবায়ক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, “সমতলের আদিবাসীদের স্বার্থ উপেক্ষিত আছে। জাতীয় বাজেটে সমতলের আদিবাসীদের জন্য কোন বরাদ্দ থাকে না।” তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মত করে সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করার দাবি জানিয়েছেন।

বর্ষীয়ান রাজনীতিক পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, “এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ছিল। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক উ শুয়ে রাখাইন ১৯৭০ এর নির্বাচনে ২২ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে দেশে লক্ষাধিক রাখাইন ছিল, সেখানে আজ ২৫০০ এর মত রাখাইনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যা অত্যন্ত দু:খজনক। আদিবাসীদের দিনদিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত করা হচ্ছে।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। আমরা সংবিধানকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পার্টির কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। এককভাবে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয় আমরা তার পক্ষে নই। এদেশে বাঙালি ছাড়াও বহু জাতির বসবাস রয়েছে। সংবিধানে তাদের স্বীকৃতি থাকা দরকার।

রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, “শোকাবহ আগস্টে আমি শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি। তাঁর শাসনামলেই গেজেট অনুযায়ী আমি চাকমা সার্কেল চীফ এর দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হই। যাই হোক, আজকে আমরা আদিবাসীদের জন্য নতুন সামাজিক চুক্তি ও অঙ্গীকারের কথা বলছি। আদিবাসীদের পূর্বসম্মতি ব্যতিরেকে তাদের এলাকায় কোন প্রকল্প, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত নয়।”

আগামী বছর জাতিসংঘ আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে একটি দশক ঘোষণা করতে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন,  “আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীতে বাংলার পাশাপাশি এদেশের অন্যান্য আদিবাসী ভাষাসমূহের মর্যাদা ও চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।”৪টি আদিবাসীর মাতৃভাষায় বই রচিত হলেও এখনো পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় নি বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।

সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “সাধারণত এমন দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে পালন হওয়ার কথা। কিন্তু দু:খের বিষয় আমাদের দেশে আদিবাসী দিবস বিষাদের সাথে পালন করতে হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা এখন সরকারের দ্বায়িত্বে আছেন। আমরা প্রায়শই জেনে থাকি আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে তিনি আন্তরিক। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো আজকে যে আমরা কাইকে পেছনে ফেলে না রাখার কথা বলছি তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে উল্টো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত আদিবাসীদের প্রান্তিকতার কিনারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। অধিকারের কথা বলেছেন। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু তো সবার কথা বলেছেন। প্রতিটি মানুষের কথা বলেছেন। বাংলার মানুষ বলতে সেখানে কী আদিবাসীরা নাই?”

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, “আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন এবং আদিবাসী বিষয়ক কমিশন গঠন করা আজ খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। আদিবাসী অধিকার আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত হতে পারবে না।”

প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মেসবাহ কামাল বলেন, “জাতীয় স্বার্থ এবং জাতিগত স্বার্থ দুটি ভিন্ন বিষয়। আমাদের দেশে জাতীয় স্বার্থ বলতে মূলত কর্তৃত্বকারী শাসকশ্রেণীর স্বার্থকেই রক্ষা করা হচ্ছে। এখানে সংখ্যালঘু জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ যথার্থভাবে সংরক্ষিত হচেছ না। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হলে সকল জাতির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।”

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শাহীন আনাম, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, হরেন্দ্রনাথ সিং, কাজল দেবনাথ, সোহেল হাজং, জান্নাত এ ফেরদৌসী, শরীফ জামিল প্রমুখ।