বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টিরও বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে গারো জাতি অন্যতম। এ জাতির বিশেষত্ব হচ্ছে, গারো জাতির মধ্যে ১৩টি সম্প্রদায় রয়েছে। আবার দোয়ালের মধ্যে একটি এবং আবেং-এর মধ্যে আরও ৩টি উপদল রয়েছে। গারো জাতিসত্তার মধ্যেই এতগুলো দল বা উপদল রয়েছে। তেমনি অন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির মধ্যেও এক বা একাধিক গোত্র, সম্প্রদায় আছে নিশ্চয়ই! কিন্ত গারো জাতিসত্তার আরও বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গারোরা জাতিসত্তায় প্রায় প্রতিটি দলের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা রয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের আগমনকালকে আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেওয়া হয়। নৃ-তত্ত্ববিদদের মতে ভারতবর্ষে মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিয়ে। এরা প্রথমে পূর্ব ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বিশেষ করে চীন-ভারতের সীমান্তবর্তী তিব্বত, ভুটান, নেপাল, সিকিম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের মোঙ্গলীয়রা প্রবেশ করেছিল মায়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে। ভারতে প্রবেশকারী মোঙ্গলীরা নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা এদের একটি শাখা প্রথমে তিব্বতের তুরা প্রদেশে ও ভুটানের নকলবাড়ি নামক অঞ্চলে বসতি শুরু করে। এই শাখাকেই ভারতবর্ষে গারোদের আদি জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গারোদের আগমনকালকে আজ থেকে যদি আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বে ধরে নেয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো এর আগে কোথায় ছিলো গারো জাতির মানুষেরা? ঝুমচাষ প্রেমী গারো জাতি যেখানেই পাহাড় জঙ্গল পেয়েছে, সেখানেই কয়েক বছরের জন্য আবাস গেড়েছে। আবার যখনই দেখেছে একই জায়গায় প্রত্যাশানুরূপ ফসল হচ্ছে না, তখনই অনত্র সড়ে গিয়ে সেখানে আবার কয়েক বছরের জন্য ঝুমচাষ করার উদ্দেশে আস্তানা গেড়েছে- গারোদের ইতিহাস, জীবন বৈচিত্র তাই বলে।

গারোরা জাতিগতভাবে আসলেই সহজ সরল, শান্তিপ্রিয়। তাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শান্তিপ্রিয় এ গারো জাতি পারতপক্ষে কারোর সাথে দলাদলিতে যেতে চায় নি বিধায় কোথাও বেশিদিন কারোর উপরে কর্তৃত্বও করে নি। অন্যদিকে কারোর কাছে মাথানত, বশ্যতা স্বীকার করেও চলতে চায় নি। ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক, যেখানেই গেছে, থেকেছে কিন্তু কোথাও দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাস করে নি। একারণে এক কথায় গারোদের বসবাসের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

ভারতীয় উপমহাদেশে গারোদের বসবাস সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্যপঞ্জি, গ্রন্থ ঘাটিয়ে এবং এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের মতামত সাপেক্ষে বলা যায়, গারোদের পূর্ব পুরুষগণ জাতি হিসাবে গারো নাম নিয়েই তিব্বত দেশ থেকে এসেছে এবং পরবর্তীতে গারো পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করেছে। এই গারো পাহাড়টির নাম গারোদেরই দেওয়া বলে সকলেই দাবী করেছেন। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার কারণে ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিলো এই গারো জাতি এবং সমাজ। সে হিসেবে গারোসহ বিভিন্ন বাংলাদেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসও প্রাচীন যা সহজেই অনুমেয় হয়।

প্রাকৃতিক নিয়মে সময় দ্রুতই বদলায়। প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনাচরণ পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনধারা, সমাজ ও সংস্কৃতি। একজন ব্যক্তিকে যা পরিচিতি করে তোলে তাহলো দৈহিক গঠন, জীবনাচরণ, সংস্কৃতি ও ভাষা। যার কিছু অংশ হয়তো মানুষের চোখে দৃশ্যমান; আবার কোনটা নয়। সমস্ত কিছুর পরিবর্তনের একটা ধারা থাকে, কিন্তু এই ধারা যদি নিয়ন্ত্রণহীন গতিবেগে ছুটতে থাকে, তাহলেই বিপত্তি। বিশ্বায়নের ফলে, সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষের আচার আচরণ, যে গতিতে পরিবর্তিত, তেমনই পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের ভাষা। ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬৭০০টি ভাষা রয়েছে, এ হিসাবে আদিবাসীদের বা সংখ্যালঘুদের ভাষাই বেশি। কিন্তু উদ্বেগজনক তথ্য যে, সাম্প্রতিকালে পৃথিবী থেকে প্রায় ২২৯টি ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে, এবং ২৫৮০টি ভাষা হারানোর পথে। ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাষাগুলো অপসংস্কৃতায়নের ফলে, সংখ্যাগুরুর ভাষার চাপে এবং নিজস্ব ভাষাগুলো প্রতি অবজ্ঞা, উদাসীনতা অথবা অব্যবহৃত ভাষাগুলো বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে।

গারোদের জাতিসত্তার মধ্যেই ১৭টি গোত্র রয়েছে এবং প্রায় সব গোত্রের নিজস্ব ভাষা রয়েছে বা ছিলো। কিন্তু গারো গবেষকদের তথ্যমতে মাত্র ৭টি গোত্রের ভাষা চলমান রয়েছে। তাহলে, আর বাকী ১০টি গোত্রের ভাষা কোথায় হারিয়ে গেছে ? নাকি, ঐ ৭ গোত্রের ভাষার সাথে মিলিয়ে গেছে ? হতেও পারে। গারো সমাজ চিন্তাবিদদের ধারণা, যে পরিমাণ গারোদের ভাষা টিকে রয়েছে, তাও বিলুপ্তির ঝুকি অনেক বেশি রয়েছে।

একটি ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে একটি সংস্কৃতি, একটি সভ্যতার নিদর্শণের বিলুপ্তি। ইউনেস্কো বলছে, প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে ২১০০ শতাব্দীর মধ্যে বর্তমানের অর্ধেক ভাষাই হারিয়ে যাবে। এই ধারায় গারোদের অবশিষ্ট ৭টি ভাষাও পড়েনিতো ? এমনটি হলে, গারোসহ অন্যান্য ভাষাভাষীদের জন্যেও ভয়ঙ্কর উদ্বেগের, হতাশার কথা!

প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠির পরিচয় হলো তার নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ভাষা। সংস্কৃতির প্রধান উপাদানই হলো ভাষা এবং বর্ণমালা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ৪৫টি আদিবাসী সমাজে নিজস্ব মাতৃভাষার মৌখিক চর্চা থাকলেও অধিকাংশ ভাষার নিজস্ব লিপি না থাকায় অনেকেই বাংলা অথবা রোমান হরফ ব্যবহার করে ভাষাচর্চা করে থাকেন। চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা মৈতৈ মণিপুরিরা নিজস্ব বর্ণমালা তৈরী করে নিজেদেরে ভেতর মাতৃভাষা চর্চা করেন। গারোরাও চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরাদের সমপর্যায়ের। গারোদের গোত্রগত ভাষার সংখ্যাও বেশি, তারপরেও একটিরও বর্ণমালা নেই কেন? প্রশ্নটা গারোদেরও, কিন্তু এর সদুত্তর কে দেবে ?

গারোসহ অনেক আদিবাসীদের লোকজ সংস্কৃতি সংরক্ষণ, ভাষা চর্চা প্রান্তিক পর্যায়ে। অনেক আদিবাসী জাতিসত্তা বিলুপ্তির পথে। বিভিন্ন গবেষণা বলছে বিশ্বে বহু আদিবাসী জাতিসত্তার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতা, দেখভালের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রগতিশীল তরুণ, সমাজ চিন্তক বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতি এবং অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়াকে আদিবাসীদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেছেন অনেকেই। বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যূতে আদিবাসী নেতাদের সফল এবং টেকসই প্রতিনিধিত্ব অপ্রতুল বলে অনেকেই মনে করেন।

বছর ঘুরে বিশ্ব আদিবাসী দিবস আসে। আস্ত যোগফল শুন্য রেখে ফিরে যায়। আবার ঘুরেফিরে আসে। ফলে বাংলাদেশে আদিবাসী স্বীকৃতি, অধিকার প্রাপ্তির ঝুলি এখনো শুন্য, তলানীতে। দেশে আদিবাসী ইস্যূগুলো নিয়ে যদি সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা না করা যায়, সেটা না মানলে সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশে আদিবাসীদের নাগরিক অধিকার যদি প্রতিষ্ঠা না করা যায় তাহলে এ ব্যর্থতার দায় ভার কার ? আমার জানা মতে, আদিবাসীরা কারোর কাছে মাথানত, বশ্যতা স্বীকার করেও চলতে চায় নি। ইতিহাসও এর স্বাক্ষী। আদিবাসীদের ওপর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে তান্ডব, নৈরাজ্য, আদিবাসীদের ভূমি দখলের হিরিক, বিভিন্নভাবে আদিবাসী নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প চলছে তখন দেশে আদিবাসী ইস্যূগুলো নিয়ে নেতা, নেতৃবৃন্দরা এতো উদাসীন কেন? আদিবাসী হট ইস্যূগুলো এভাবে তলানিতে পড়ে থাকলে ইস্যূরভারে পাত্রটি ঝং ধরে পাত্রের তলানিও একদিন ফুটো হয়ে যায় কিনা, কে জানে !