জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউব এবং ফ্রিল্যান্সিং কথাটি গত কয়েক বছর আগেও আমাদের কাছে একদমই অপরিচিত একটি শব্দ ছিল। এবং আর এ দুটো প্লাট ফর্ম থেকে অর্থোপার্জন করা যায়, কথাটিও একেবারে অবাস্তব মনে হতো। আজ থেকে প্রায় পনেরো বছরে আগে ইউটিউব যাত্রা শুরু (২০০৫ সালে) এবং ফ্রিল্যান্সিং যাত্রা করে ঠিক এর সাত বছর পর (২০১২ সালে)। সব কিছুকে পেছনে ফেলে সময়টা এখন ২০২০ সাল। সব কিছুর সাথে পরিবর্তন হয়েছে মানুষের কাজকর্মের প্লাটফর্মেরও। অনলাইনটা যেন আমাদের নিত্য দিনের কাজকর্মের প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ছোট থেকে বড় সব ধরনের মানুষ এখন অনলাইন ব্যাবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠছে।
বলা বাহুল্য স্বাভাবিক জীবন-যাপনেই আমরা ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর কতখানি নির্ভরশীল দিনকে দিন তা প্রত্যেকেই হারে হারে টের পাচ্ছি। অনলাইনে থেকে কাজ সম্পাদন করতে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ওপর আমরা অনেকেই বলা চলে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। দেশে বিদেশের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে কাজগুলো সহজ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ করিয়ে নেবার প্রবনতাও অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
পাশাপাশি কেউবা আবার ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে অর্থোপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছে; যাকে আমরা বর্তমান সময়ে ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্ত পেশা বলে থাকি। ইউটিউবিং এটিও ফ্রিল্যান্সিং পেশার আওতার বাইরে নয়।
ফলে একদিকে যেমন সোস্যাল মিডিয়ায় ইউটিউবের দাপট; এবং ইউটিউব ক্রিয়েটররা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট বা বাজার দখল করতে স্বক্ষম হয়েছে। যেখানে পেশাদার ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন নিয়মিত এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
ইউটিউবিং সুবিধা অসুবিধাগুলো কি কি ?
জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউবে কাজ করাটা ফ্রিল্যান্সিং পেশার মতোন সহজ এবং মুক্ত পেশা হলেও; সুবিধার চাইতে অসুবিধাগুলো বেশি লক্ষণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ অনেকটা সময় এবং ওসব ধাবগুলো পার করতে হয়। ইউটিউব একাউন্ট সহজে এন্ট্রি করা গেলেও সহজে অর্থোপার্জনের পথ ততটা সহজে আসে না। পুরোটাই নির্ভর করে আপনার কনটেন্ট চাহিদা এবং মনিটাইজেশানের ওপর।
আপনার মনিটাইজ চ্যানেলে বিজ্ঞাপনযুক্তকরণ, এফিলিয়েট লিঙ্কগুলি ব্যবহার করে এবং আপনার ভিডিওগুলিতে স্পনসর করা প্লেসমেন্টগুলি বিক্রি করে আপনি আপনার আয়ের সম্ভাবনা সর্বাধিকতর করতে পারেন।
এছাড়াও ইউটিউবে, আপনি কোনও সিপিএম (CPM), সিপিভি (CPV) এবং সিপিসির (CPC) ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন থেকে অর্থোপার্জন করতে পারেন। প্রতি ইম্প্রেশন ব্যয় (সিপিএম) দিয়ে একজন সাধারণ ইউটিউবার প্রতি ১০০০ ভিউতে ৭.৬০ ডলায় আয় করতে পারে।
আপনি চ্যানেলের মালিক হিসাবে অনুমোদিত বিপণন ব্যবহার করছেন, বিজ্ঞাপনদাতারা বিভিন্ন মডেলের সাথে অর্থ প্রদান এবং বিতরণ করেন থাকেন-এটি সাধারণত বিক্রয় প্রতি ব্যয় বা লিড প্রতি ব্যয় নির্ভর করে। এখানে, আপনার উপার্জনগুলি বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া কনভার্সন এবং বিক্রয় কমিশনের সংখ্যার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
আপনি আপনার ভিডিওগুলিতে স্পনসর করা পণ্যের প্লেসমেন্টগুলিও বিক্রি করতে পারেন। এখানে ইউটিউবারগুলি এক্সপোজারের সন্ধানকারী ব্র্যান্ডগুলিতে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ বা আরও সুপারিশকৃত এবং বর্ধিত পণ্য বিক্রি করে অর্থোপার্জন করে।
তবে, আপনি যদি আপনার চ্যানেলে একটি পরিমাপযোগ্য এবং আস্থাযোগ্য অডিয়েন্স তৈরি করতে সক্ষম হন তাহলে ব্র্যান্ডগুলি আপনাকে অর্থ প্রদান করতে পারে, যেমন আপনার চ্যানেলে পাওয়া প্রতি কয়েক হাজার ভিউয়ের জন্য এই দামটি ২০ থেকে ৫০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
সুতরাং একটি উদাহরণস্বরূপ দেয়া যেতে পারে, যদি আপনার চ্যানেলে তাদের ভিডিও কয়েক মিলিয়ন ভিউ হিট করে তবে আপনি ২০,০০০ ডলার থেকে ৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত আর্ন করতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি যখন লক্ষ লক্ষ ভিউ তৈরি করছেন না তখন এই কৌশলটি মনিটাইজের জন্য আরও একটি ভাল উপায়।
ইউটিউবে লেন-দেনের মূল আরেকটি যে বিষয় সেটি পরিস্কার জেনে রাখা ভালো; গুগলের নীতিনুসারে, ক্রিয়েটরসরা বিজ্ঞাপন থেকে উপার্জিত ৫৫% পারিশ্রমিক পান এবং গুগল পান ৪৫%।
ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিত কনটেন্ট আপলোড করতে হয়; রিকোয়্যার্ড সাবস্ক্রাইবার, ভিউস এবং ওয়ার্চ আওয়ার অর্জন করার পর মনিটাইজাশানের জন্য আবেদন করতে হয়। সেটি বারো মাসের কম সময় অথবা অধিক সময়ও হতে পারে।
ইউটিউব পেশায় কপিরাইট ক্লেইম, কপিরাইট ষ্ট্রাইকের ব্যবস্থা অবধারিত;এবং সে জন্য আপনার কনটেন্টগুলো ইউনিক হতে হবে। ফলে কনটেন্ট ক্রিয়েটরকে
কঠোর কমিনিউটি গাইড লাইন মেনে চলতে হয়; তা-না হলে চ্যানেলটি সাসপেন্ড হওয়ার শতভাগ নিশ্চিত থাকে।
ইউটিউব পেশায় মনিটাইজেশানের পর সাবস্ক্রাইব মূল বিষয় নয়; মূল বিষয় হলো আপনার আপলোডেড কনটেন্টের ভিউসের ওপর উপার্জন নিভর করে। এবং ভিউস কারেন্সি কান্ট্রিওয়াইস ভেরি করে।
ভিডিও ইডিটিং এবং কনটেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত ইক্যুায়িপমেন্ট সহজলভ্য নয়; কোন ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে।
মনিটাইজেশান ইউটিউব চ্যানেল থেকে অর্জিত অর্থ প্রতিমাসে এবং সঠিক সময়ে পাওয়ার কোন বাধা ধরা সময় সীমা নেই; তবে উপার্জিত অর্থ আপনার একাউন্টে অর্থ পেয়ে যাবেন সেটা গেরান্টিড।
ফ্রিল্যান্সিং সুবিধা অসুবিধাগুলো কি কি ?
ফ্রিল্যান্সিং পেশায় অসুবিধার চেয়ে সুবিধাগুলো বেশি চোখে পড়ে। আপনি যদি একাধিক বিষয়ে দক্ষ হয়ে থাকেন; তাহলে যেকোন মার্কেট প্লেসে দক্ষতার সহিত কাজ করতে পারেন। সহজে অর্ডার পাওয়া এবং অনায়াসে অর্থোপার্জন করতে স্বক্ষম হবেন।
ফ্রিল্যান্সিং করার সব থেকে বড় সুবিধা আপনি ঘরে বসেই কাজ করতে পারবেন। ঘরে বসে অনলাইন ব্যাবহার এর মাধ্যমে আমরা যেকোন কাজ করতে পারবেন; এবং এটিই ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্ত পেশা।
এটির সব থেকে বড় সুবিধা আপনি আপনার নিজের ইচ্ছা মত কাজ করতে পারবেন। আপনি কোন কোম্পানিতে রেগুলার জব করেন; সেক্ষেত্রে আপনাকে প্রতিদিন সময় মত অফিসে যেতে হবে, সময় মত কাজ শেষ করতে হবে, এবং কাজ শেষে বাসায় ফিরতে হবে।
অনেকের কাছে রেগুলার চাকরি করাটা বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু আপনি যদি ফ্রিল্যান্সিং করেন তাহলে আপনি আপনার ইচ্ছামত কাজ করতে পারবেন। অর্থাৎ ৯-৫টা ঘড়ি ধরে অফিস করতে হবে না।
আপনাকে কোন অফিসে যেতে হবে না। আপনি ঘরে বসেই কাজ করতে পারবেন। ফ্রিল্যান্সং পেশায় নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পারলে; আপনি আপনার জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারবেন।
কোন কোন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট প্লেসে এন্ট্রি লেভেল অনেক সহজ এবং শুধু মাত্র একটি কাজের ভালো দক্ষতা দিয়েও সহজে কাজ পাওয়া যায়; যদি কমিনিউকেশান স্কিল ভালো থাকে।
বায়ারের রিকুয়েস্ট অনুযায়ী প্রকল্পগুলো গুরুত্ব দিয়ে কাজ সম্পাদন এবং সঠিক সময়ে কাজটি করতে হবে ; যাতে পরবর্তীতে আপনার কাজের মূল্যায়ন সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়।
বায়ারের চাহিদাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তা-না হলে রিভিউ বিষয়টি আপনাকে ভীষন চাপে ফেলতে পারে। পজিটিভ রিভিউ না হলে মার্কেটে টিকে থাকা সহজ হয়ে উঠবে না। অর্থাৎ আপনার সময় উপযোগি যোগাযোগ, কাজের দক্ষতা এবং বায়ারের রিভিউ আপনার স্থানটি নিশ্চিত করে।
ফ্রিল্যান্সিং পেশায় কপিরাইট ক্লেইম, কপিরাইট ষ্ট্রাইকের ব্যবস্থা নেই; তবে আপনার কাজগুলো ইউনিক হতে হবে।
আপনার উপার্জিত টাকা সঠিক সময়ে এবং আপনার একাউন্টে পেয়ে যাবেন।
ইউটিউবিং নাকি ফ্রিল্যান্সিং করবেন?
ইউটিউবিং নাকি ফ্রিল্যান্সিং প্রশ্নটি আপনাকে গোলক ধাঁধায় ফেললেনাতো! যা হোক আর গোলক ধাঁধা নয়, বাস্তব এবং ছো্ট্ট উদাহরণ দিয়ে বুঝার কাজটি সেরে নেয়া যাক; যাতে কারোর বুঝতে বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত ইউটিউবার প্রতি ১০০০ ভিউতে ৭.৬০ ডলায় আয় করতে পারে; যদি সেটা ভালোমানের কনটেন্ট হয়; অর্থাৎ পুরোটা নির্ভর করে ভিউয়ারের ওপর। আর ফ্রিল্যান্সিং পেশায় মিনিমাম ৫ ডলারে অর্ডার পেতে পারেন/অর্ডারের রীতি রয়েছে; এর উপরেও হতে পারে যা অর্জন করতে সর্বোচ্চ এক ঘন্টা লাগতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে পেশাদার ফ্রিল্যান্সারের পারিশ্রমিক ঘন্টায় ১০ ডলারের অথবা এর অধিকও হতে পারে। অর্থাৎ কোন কাজে নেগোসিয়েট করে প্রকল্পনুযায়ী ১০০- ৫০০০ ডলার হতে পারে; প্রকল্পটি শেষ করতে সর্বনিম্ন দু’দিন অথবা দু’সপ্তাহ আপনার লাগতে পারে; অথবা এরও কিছু কম সময়।
আলোচ্য পুরো বিষয়টি বুঝার এবং সিদ্ধান্ত এখন আপনার হাতে। একটি কথা মনে রাখবেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপনার সিদ্ধান্তহীনতা সময় এবং অর্থ অপচয়ের নামান্তর হতে বাধ্য।
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী