ওয়ানগালা গারো সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। এটি একসময় ধর্মীয় রীতিতে পালিত হলেও সাংসারেক থেকে খ্রিস্টান ধর্মে কনভার্ট হওয়ার ফলে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। অনেক গারো এখন ওয়ানগালা বললে নাক সিটকান, সাংসারেক রেওয়াজ বলে সন্তর্পনে এড়িয়ে যান। তাঁরা আবার এই উৎসবকে ‘খ্রিস্ট রাজার পর্ব’ হিসেবে পালন করেন, যা একেশ্বরবাদী ধর্মের আধিপত্যকেই নির্দেশ করে। একেশ্বরবাদীরা নিজধর্মকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে, বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য শক্তিকে অস্বীকার করে নিজের বিশ্বাসকে জোর করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এরফলে দেখা দেয় বিবাদ, সংঘর্ষ। সৃষ্টি হয় ধর্মযুদ্ধের। এই আলাপ আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
১৮৬২ সালে গারোরা প্রথম খ্রিস্টান হয়। এরপর আদি ওয়ানগালা পালন কমে যেতে থাকে, বলাবাহুল্য, পুরোহিতদের ছিল নিষেধাজ্ঞা। গির্জায় গারোদের সাংস্কৃতিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ, সম্ভবত দেব-দেবতার প্রতীক বলে। যদি কেউ আদি বাদ্যযন্ত্রগুলো গির্জায় আনতো তবে তাঁকে প্রায়শ্চিত্র স্বরূপ শাস্তি দেয়া হতো। গারোঞ্চলে এমন অনেক ঘটনা আছে। পরে পোপ মহোদয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর সারাবিশ্বের ক্যাথলিক ধর্মানুসারীর জনজাতির মানুষ যারযার সংস্কৃতি, আদি উৎসব উদযাপনের অনুমতি পায় তবে সেটি উদযাপিত হয় খ্রিস্টীয় রীতিতে।
খ্রিস্টীয় রীতিতে ওয়ানগালা উদযাপিত হচ্ছে— সেখানে মিসি সালজং, রক্ষী মেমা, রাক্কাসি আমুয়া কিংবা তাতারা রাবুগার জায়গায় যীশুর গুণকীর্তন গাওয়া হয়। তাতারা রাবুগারা বিতাড়িত, কিন্ত পরাজিত না। পরাস্ত হলে জনিক নকরেক, শীতল স্নাল কিংবা ওয়ারী নকরেকের মতো আদিপ্রাণেরা হৃদয়ে ‘সাংসারেক বিশ্বাস’ সযতনে পুষে রাখতো না, চুনিয়ায় আদি রীতিমতো ‘পিউর ওয়ানগালা’ হতো না।
রূপান্তর সংস্কৃতির ধর্ম— এটি মেনেই আপত্তি সত্ত্বেও বলা লাগে, যেভাবেই হোক ওয়ানগালা তো উদযাপিত হচ্ছে! গারোঞ্চলের মিশনগুলোতে ওয়ানগালা (খ্রিস্ট রাজার পর্ব) উদযাপন করা হয়, ঢাকায় তিনটা; এই তিনটি ওয়ানগালা নিয়ে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। ঢাকাবাসী গারো জনগোষ্ঠী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ওয়ানগালা আয়োজন করে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ‘সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের অধিকার’ সংক্রান্ত ধারানুসারে অফিসিয়ালি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।
ওয়ানগালায় ৭—৮ হাজার বা আরো ততোধিক মানুষের সমাগম ঘটে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বড় মাঠের প্রয়োজন হয়। মাঠের সংকট অনেক সময় ওয়ানগালা উদযাপনে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি মাঠগুলো পেতেও বেগ পেতে হয়। এক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি চর্চা, অধিকার নিশ্চিতে সরকারের সুনজর কাম্য।
ওয়ানগালা নিঃসন্দেহে একটি বড় ইভেন্ট। প্রায় তিন চার মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া লাগে। বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন পড়ে। এখান থেকে ওখান থেকে টেনেটুনে আয়োজন করা লাগে। যাঁরা অতিকষ্টে ওয়ানগালা আয়োজন করে, ঢাকাবাসী গারোদের একত্রিত করবার সুযোগ তৈরী করেন তাঁরা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।
কয়েকদিন আগে ঢাকার তিন ওয়ানগালার তারিখ জানিয়ে একটি পোস্ট করেছিলাম। সেখানে একজন প্রশ্ন তুলেছেন— ‘তিনটা কেন করা লাগে? একসাথে করলে সমস্যা কী?’ এই প্রশ্ন ওয়ানগালাকে অতি সরলীকরণ করে ফেলেছে। ওয়ানগালা তিনটা কেন আরো করলেও সমস্যা নেই, এটা ঐক্য কিংবা অনৈক্যের বিষয় নয়। প্রসঙ্গ সংস্কৃতি চর্চার। তবে কিন্ত থাকে যে, সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে রুগালা, ওয়ানগালা যেন ব্যবসায়িক ইভেন্টে পরিণত না হয়। এদিকটায় কড়া নজর দরকার।