জাতি সংঘের আদিবাসী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্রের ৪৬টি অনুচ্ছেদানুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠির অধিকার সংরক্ষণ করে শুধু তা-ই নয়; বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠির অধিকারেরই একটি অংশ এটিও সন্দেহাতিৎভাবে বলা যায়। জাতিগোষ্ঠি বিবেচনায় এটিই হলো অধিকার এবং একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠির ক্ষেত্রে সকলের সমষ্টিগত অধিকার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় আইনে সমধিকার হওয়া উচিত। জাতি সংঘের ঘোষণা পত্রটি ধারণ করতে হবে এমনও নয়; নাগরিক অধিকার হিসেবে অবশ্যই বিবেচনার অধিকার রাখে কী? আচ্ছা, আপনি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠি হিসেবে স্বীকৃতি দিবেন না ভালো কথা, তাহলে সাধারণ আদিবাসী নাগরিক হিসেবে দেশে সমধিকারটা কোথায়?

সরকারকে একতরফা দোষ চাপিয়েইবা কী লাভ ! তবে আশার কথা হলো এ যুগে আদিবাসীরাও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। পঞ্চাৎপদ আদিবাসীরাও অনেক ক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য এগিয়েছে, এগিয়ে যাচ্ছি বটে। কিন্ত এমন এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন ছন্দ নেই, দেখছি না অদ্যাবধি। এমন ছন্দ পতনের হেতুও আমাদের জানা নেই। বুঝে উঠতে পারছি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “যে গতিতে ছন্দ থাকে না, তাকে দুর্গতি বলবো।” কবিগুরুর কথায় যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। আদিবাসীদের কপালে দুর্গতির লাল টিপ পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু প্রগতিশীলরা চাক্ষুষেই বলেন যে, আদিবাসী সমাজে ভুল নেতৃত্বের কারণে রাষ্ট্রের কাছে আদিবাসী স্বীকৃতি এবং অন্যান্য ন্যায্য অধিকার পাওয়া আদায় হয় নি। আদিবাসীদের জাতীয় রাজনীতিতে অদুরদর্শী এবং ভঙ্গুর নীতির কারণে জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে বিশ্ব আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করলেও রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র নির্ভিগ্নে পাশ কাটিয়ে যাবার সাহস পায়। আদিবাসী দিবস পালনে মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়াতে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করা যাবে না বাংলাদেশ সরকারের বাড়াবাড়ির এমন বিষয়টিও আমাদের এখনো সহ্য করতে হয়।

দেশের সরকার যাই করুক ! আদিবাসী জনগোষ্ঠী আজও পৃথিবীর নানান দেশে দেশে নানান মাত্রায় সামাজিক, সাংস্কৃতি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রান্তিকায়নের শিকার। এ বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অধিকার দেখভাল এবং এ বিশাল ভাষাগোষ্ঠী এবং বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সংরক্ষণের তাগিদ থেকেই ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

আমরা প্রতিবছর ৯ আগস্টে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করি। জাতিসংঘ ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালন করে আসছে এই দিবসটি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদশে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি, সম্প্রদায় বা উপজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করলেও বাংলাদেশের আদিবাসীরা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে যা সুধীসমাজের লেখনী, তাদের কথা বার্তায় এখনো জাগ্রত রয়েছে। জাতিসংঘও তাদের দাপ্তরিক কাজে ইন্ডিজিনাস অর্থাৎ আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করে। এহেন প্রশ্ন রয়েও গেলে যে, আমাদের দেশে এমনটা হয় না কেন ?

বাংলাদেশী তথা বাঙালী রাজনীতির ময়দানে আদিবাসী নেতৃত্ব, রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনৈতিক সত্তার ভিন্ন অস্তিত্ব নিয়ে আজকের বাংলাদেশে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চরম টানাপোড়েন চলছে। এর কারণ হলো, রাজনৈতিক ময়দানে নেতৃত্বের ধরণ, চলন-বলন দৃশ্যত দেখে মনে হতে পারে নেতা হওয়া, রাজনীতি করা যেন ডাল ভাতের বিষয়। অতপর ‘নেতা’ নামক শব্দ কাঁধে ঝুলিয়ে নিজের বুকে নেতার বিয়ারিং সিল মেরে মিথ্যাকে আলিঙ্গন করে “সততা” নামক শব্দটির ঘরে খিরকি দিয়ে আমাদের আদিবাসী বড় ভাইয়েরাও দেদারসে রাজনীতি করে যাচ্ছে। এদিকে অবিশ্বাসের তীব্র দাবদাহে বিশ্বাসের পাথর চড়টি নতুন জোয়ারে বাঁধ ভাঙ্গা বালুর মতো ভেসে যাচ্ছে। নিজের অজান্তে তৈরী হচ্ছে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ ব্যবধানের পিচঢালা প্রশস্ত পাকা রাস্তা। বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের বৈষয়িক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, নানা কৌশলে বিত্ত-বৈভব আহরণ, ক্ষমতার দাম্ভিকতা ইত্যাদির হিসাব নিকেশ শুনতে শুনতে ক্লান্ত, পথভ্রস্ত আদিবাসী সাধারণ নাগরিক সমাজও। সামাজিক, রাজনৈতিক নানা সমিকরণ-মহাসমিকরণ ভেরাজালে দেশসহ আদিবাসীরাও আজ ত্যাক্ত-বিরক্ত এবং দ্বিধা-ভিভক্ত।

এহেন পরিস্থিতিতে মনে অবশ্যই এমন একজন আদিবাসী নেতা পাওয়ার আশা আকাঙ্খা কার না স্বাদ জাগে? মোদ্দা কথা যিনি আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করেন। শোষণমুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যিনি আজীবন বিশুদ্ধ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাবেন। আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমাজ এবং জাতির স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করবেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদে জাগতিক ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে জাতি এবং সমাজের তরে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিবেন ইত্যাদি বিষয় চলে আসে।

আমাদের আদিবাসী সমাজেও আদর্শবান, বিশুদ্ধ নেতা প্রয়োজন ভালো কথা ! কিন্ত ওরা কিভাবে নেতা বনে যায়, ক্ষমতায় আসে, ক্ষমতার স্বাদ একবার পেলে আজীবন কিভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জানে সেটিও আপনি নিশ্চয়ই ভালো জানেন । কারণ আপনি তাকে ভোট, সমর্থন দিয়েছেন বলেই সে আজ নেতা, রাজনীতিবিদ !

এবার আপনি নিজে ভাবুন, দেশে আদিবাসী স্বীকৃতি, দেশে আদিবাসী অধিকার না পাওয়ার গণ দায় আসলে কার ? আপনার, নাকি আদিবাসী নেতাদের !

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী, lchiran76@gmail.com