টাঙ্গাইলের মধুপুরে ইকোপার্কসহ নানা প্রকল্পের নামে আদিবাসীদের বসতভিটা, আবাদী জমি দখল ও উচ্ছেদের পায়তারা করছে সরকার এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিমান ফায়ারিং রেঞ্জ, ইকোপার্ক, আরবোরেটাম, সুফল প্রকল্প নামে নানা সামাজিক বনায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাকৃতিক বন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে-ই।
প্রাকৃতিক বন উজার করে স্বার্থান্বেষী অ-আদিবাসী কিছু মহলকে সামাজিক বনায়নের নামে বনভূমি ইজারা দিয়ে সে জমিটি আবার স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে বন বিভাগ। এছাড়াও বনভূমিকে কেন্দ্র করে সরকার ও রাজনীতির ছত্র ছায়ায় এ আগ্রাসন আরও যেন তীব্রতর হচ্ছে দিনকে দিন। সেখানকার এলাকাবাসী, সংগঠন এবং আদিবাসী ছাত্র সংঠন বলছে- ‘মধুপুরে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অঞ্চলে নানা প্রকল্পের ছুতো ধরে সেই ইকোপার্ক প্রকল্পকেই ভিন্ন নামে বাস্তবায়ন করে চলেছে দেশের সরকার। সরকার এখন বুঝে গেছে ইকোপার্ক নামে মধুপুরে কোন প্রকল্প সরাসরি করা যাবে না। প্রকল্প সেখানে করতে হলে ইকোপার্কের আদলে বিভিন্ন নামে বা প্রকল্পের নাম ঘুরিয়ে যেকোন মূল্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে, বরং তাদের অধিকার খর্ব, জুলুম, নির্যাতন, বসতভিটে বেদখল করে দেশের আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পায়তারা করে চলেছে। সরকারের এমন নিত্য নতুন খায়েস দেখে সত্যিই অবাক হতে হয় যে, এ কোন গণতান্ত্রিক দেশে আমরা আছি ? এ কোন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে আমরা বসবাস করছি।‘
মধুপুর দোখলা রেস্ট হাউজ ও লেক প্রকল্প, প্রকল্পের কাছ গারোদের আমতলী বাইদের ধানী জমি , ছবি: জন জেত্রা
কৃষিমন্ত্রী (টাঙ্গাইল-১ আসন) ড: মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক গত ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার দোখলা রেস্টহাউজের মিলনায়তনে আদিবাসীদের সাথে আলোচনায় বসেন। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজরিত দোখলায় আধুনিক রেস্টহাউজ ও লেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। রেস্ট হাউজের শোভাবর্ধনের জন্য আরও বাস্তবায়ন প্রকল্পে আদিবাসীদের ধানী জমিতে বিনোদনের জন্য কৃত্রিম লেক তৈরি করবেন। এহেন কথা হলো, যেখানে বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী খাদ্যসহ সকল মৌলিক চাহিদাগুলো পায় না আর আপনি সেখানে আদিবাসীদের ধানী জমিতে আধুনিক লেক তৈরি করবেন সেটা করতে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ একমত হবেন আপনি ভাবলেন কি করে ? বাংলাদেশে এমনিটেই মোটা দাগে খাদ্য সংকট রয়েছে; এরপর আবার ধানী জমি ব্যবহার করে বিনোদন লেক তৈরি করলে আদিবাসীসহ সেখানকার জীব বৈচিত্র রক্ষা করবে কিনা; সেটা কেন একবারও ভাবলেন না! সরকার কী মনে করে, বিদেশি পর্যটক এসে আদিবাসী নারীদের শাড়ির আচল ধরে ভোগ্যপণ্য মনে করবে, আর সেখানে আদিবাসীরা পর্যটকদের রঙ্গ তামসা দেখে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে !
দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত জাহিদুর রহমানের প্রতিবেদন (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)- সুফল প্রকল্পে ‘কুফল’ শিরোনামটি যথার্থ। সে প্রকল্পে বলা হয়, বনকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর বননির্ভরতা কমিয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি ইত্যাদির টেকসই ব্যবস্থাপনা। অর্থাৎ টেকসই বন ও জীবিকা বা সাসটেইনেবল ফরেষ্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড (সুফল) প্রকল্প। বন অধিদপ্তরের এ প্রকল্পটি ৫ বছর মেয়াদি। যা ২০২৩ সালে শেষ হবার কথা রয়েছে। প্রকল্প বাবদ এক হাজার ৫০২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে সরকারকে ৩২ কোটি ৭২ লাখ টাকা অর্থায়ন করা করছে এবং বাকি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে আরও বিস্তারিত বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় বানায়ন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসন, বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার তালিকা ও বন নির্ভর পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া। এর মাধ্যমে দেশের জাতীয় বনাঞ্চল ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে বলেও প্রকল্পে উল্লেখ করে। কিন্ত এ প্রকল্পের বাস্তবতা আসলে এর উল্টো চিত্র আমরা দেখছি। মধুপুর অঞ্চলে যে প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে বা হচ্ছে কোনটাই টেকসই প্রকল্প নয়; বরং যাও প্রাকৃতিক, জীব বৈচিত্র ছিল তাও সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় দ্রুত হারাতে বসেছে। এসব বিফল প্রকল্পের নামে দেশকে ঋণগ্রস্থ করছে শুধু তা নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবন জীবিকা এবং অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশের অপরিণামদর্শী বনবিভাগ।
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ। আমার কথা হলো, প্রাকৃতিকভাবে যেখানে অলরেডি লেক কিংবা বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত রয়েছে সেখানে আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করুন। অথবা পদ্ম মেঘনার পাড়ে চরগুলোতে রোহিঙ্গাদের পুন:বাসন প্রকল্প না করে সেগুলো আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্যে থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করুন।
মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয় আপনাকে সবিনয়ে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজরিত দোখলা আধুনিকায়নের তুলনায় যা আছে তা সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করুন। রেস্টহাউজ ও লেকের নামে ‘ফেইক’ প্রকল্পে সেখানকার আদিবাসীদের জীবন মানকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবেন না। দেশের সরকারকেও ‘বিফল প্রজেক্ট’ এর নামে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়াবেন না।