সম্ভবত মানুষ ছাড়া প্রকৃতির খুব বেশি সমস্যা হতো না; কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া মানুষের জীবন অকল্পনীয়।
বছর খানেক আগের কথা। আমরা ক’জন যাচ্ছিলাম গহীন পাহাড়ের অমসৃন জঙ্গল আবৃত পথ ধরে। কখনো খাড়া পাহাড় কখনো ঝিড়ি-ঝর্ণা ডিঙ্গিয়ে। হঠাৎ করে একটা ঝন ঝন শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগলো। আমি খানিকটা বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, এতো দুর্গম এলাকায় খুব সহজে মানুষের পদচিহ্ন পড়ে না, সেখানে যন্ত্রের শব্দ আসছে কোথা থেকে? আগ্রহ নিয়ে আমরা সেই শব্দের উৎসের সন্ধান করতে লাগলাম। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে যা আবিস্কার করলাম তা আমার ভাবনার বাহিরে ছিলো, রীতিমতো চোখ কপালে উঠে গেলো।
প্রাকৃতিক ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন, ছবি: দিয়াত মাহমুদ শাকিল
দুর্গম এই পাহাড়ে পানির ঝিরি থেকে পাথর উত্তলন করছে একদল মানুষ। তারা ইস্পাতের আঘাতে ঝিরির বিশাল আকৃতির পাথরগুলোকে খন্ড খন্ড করছে। তারপর সেগুলো মেশিনের সাহায্যে আরো টুকরো করা হচ্ছে। আর এই মেশিনের আওয়াজ-ই আমরা দুর থেকে শুনেছিলাম। এখানেই শেষ নয়, এরপর সেই খন্ডকৃত পাথরগুলো ট্রাকে ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভোক্তাদের কাছে। এমন দুর্গম এলাকায় তারা ট্রাক চলাচলের জন্য পাহাড় কেটে রাস্তাও নির্মাণ করেছে। তারা যেন পাহাড় ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে!
পাহাড়কে কারা এভাবে গিলে খাচ্ছে? সে কথা কি প্রশাসনের অজানা? পাথর ভাঙার এসব শ্রমিকগন জানান তারা দৈনিক হাজিরার বিনিময়ে কাজ করেন এবং প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নাকি এসব কর্মকান্ড চলে! প্রশাসন মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দুই একজন শ্রমিককে গ্রেফতার করে আবার ছেড়েও দেয়। কিন্ত সব সময় পর্দার আড়ালে-ই থেকে যায় এসব কর্মকান্ডের মুল হোতারা।
পাহাড়ের বাসিন্দারা প্রত্যক্ষভাবে এইসব ঝিরি-ঝর্ণার পানির উপর নির্ভরশীল। তাদের খাওয়া, গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় পানির যোগান দেয় ঝিরি-ঝর্ণাগুলো। কিন্তু এভাবে ঝিরি থেকে পাথর উত্তলনের ফলে ঝিরিগুলো পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণা গুলোতেও পানি কমে যায়। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে দেখা দেয় তীব্র সুপেয় পানির সংকট। অপরদিকে পাথর পরিবহনের জন্য অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করায় পাহাড় ধ্বসের শঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ আমরা রাঙামাটিতে পাহাড় ধ্বসে শত মানুষের মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়েছি।
উত্তোলনকৃত পাথরগুলো ট্রাকে যাচ্ছে ভোক্তাদের কাছে, ছবি: দিয়াত মাহমুদ শাকিল
সম্ভবত মানুষ ছাড়া প্রকৃতির খুব বেশি সমস্যা হতো না; কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া মানুষের জীবন অকল্পনীয়।
এই বন-পাহাড় আমাদের মা। মা’কে পরম মমতায় বুক দিয়ে আগলে রাখতে হবে। প্রকৃতির উপর এই শোষণের যাঁতাকল বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য প্রকৃতি নয় বরং মানুষ-ই দায়ী।
দিয়াত মাহমুদ শাকিল
শিক্ষার্থী ও মানবাধিকার কর্মী।