আ.বিমা টাইমস নিউজ ডেস্ক: আদিবাসী জনগোষ্ঠির দীর্ঘদিনের স্বত্ব দখলীয় ভূমি হতে উচ্ছেদের নোটিশে মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীরা আবার বিক্ষোভে ফুসে উঠেছে। টাঙ্গাইল জেলায় মধুপুর থানার বনবিভাগ এ উচ্ছেদ নোটিশটি জারি করেন। ফলে সেখানকার আদিবাসীরা বন বিভাগের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলেছে, এবং বিক্ষুদ্ধ জনতা আজ সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল এবং মানব বন্ধনসহ প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি দাখিল করেন। এছাড়াও প্রতিবাদ সমাবেশে নেতারা এদত বিষয় অবিলম্বে আলোচনায় বসার জন্য এলাকার মন্ত্রী মহোদয়কে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম ছুঁড়ে দেন।
ফটো ক্রেডিট: লিয়াং রিছিল, মধুপুর
আজ সোমবার (২৫শে জানুয়ারী ২০২১) প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচীটি সকাল ১০টায় সরকারী রানীভবানী উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জমায়েত হয়ে মধুপুর বাসস্ট্যান্ড (আনারস চত্তর) প্রদক্ষিণের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী পরিষদ অফিসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে এক স্মারকলিপি প্রদান করেন (স্মারকলিপির অংশ নীচে দেখুন)। এতে এলাকার আদিবাসী সংগঠনসহ এলাকাবাসীরা স্বত:
বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচীতে সেখানকার উত্তপ্ত আদিবাসী নেতারা অভিযোগ করে বলেন, গেল ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ইং তারিখ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফত এবং পরবর্তীতে ২২ জানুয়ারী ২০২১ জাতীয় ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারেন যে, বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করে আগমী ৩০ জানুয়ারীর মধ্যে উচ্ছেদের নোটিশ দিতে বলা হয়েছে। সেখানে আরও উল্লেখ রয়েছে সারাদেশে মোট ৩৩ লাখ ১০ হাজার ৯০৭ দশমিক ৫২ একর সংরক্ষিত বনভূমি রযেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর বনভূমি অবৈধ দখলকারীর তালিকাও তৈরি করেছে। প্রথামিকভাবে যে এলাকাগুলোতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে যেমন, গাজীপুর টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজার এলাকায়।
ফটো ক্রেডিট: লিয়াং রিছিল, মধুপুর
এহেন প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, গেল ৩রা জানুয়ারী মধুপুরে ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনটি পালিত হয়েছে। ২০০৪ সালের ৩রা জানুয়ারী মধুপুরের ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে যৌথবাহিনীর গুলিতে পীরেন স্নাল নিহত হন। গারো আদিবাসী সংগঠনগুলো দিনটিকে প্রতি বছর স্মরণ করে আসছে। দিনটিকে পালনের মাধ্যমে মূল অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারসহ এবং মধুপুর গড়াঞ্চলে ইকোটোরিজ্যাম চিরতরে বন্ধের গণদাবি উঠেছে ঘটনার পর থেকে।
২০০০ সাল বন বিভাগ পরিকল্পনা করে মধুপুরে ইকো পার্ক তৈরির। বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয় টাঙ্গাইলের মধুপুরে শালবন অঞ্চলে। ১০টা আধুনিক পিকনিক স্পট, ৬টা ব্যারাক; এছাড়াও বানানো হবে পর্যটকদের জন্য নানান সুবিধা। অর্থাৎ ৪৭৮ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী শালবন পুরোটা ঘিরে ফেলে এই ‘ইকো’পার্ক বানানো হবে। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি আদিবাসীদের বিক্ষোভ মিছিলে বনরক্ষীদের অর্তকিত গুলিতে নিহত হন পীরেন ম্নাল। এতে আহত হয় আরও শতাধিক লোক। তাদের অনেকে এখনও আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। যার সুবিচার আজও গারো আদিবাসীরা পায়নি।
বন বিভাগের নতুন নোটিশের প্রেক্ষিতে মধুপুর গড়াঞ্চলের গারো, কোচ, বর্মনসহ ২৫ হাজার আদিবাসী জনগোষ্ঠির মধ্যে আবার তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। আদিবাসীদের দাবি আজ থেকে প্রায় তিনশত বছর পূর্বে তাদের পূর্বপুরুষণ এ এলাকায় বসবাস করেছেন এবং বংশানুক্রমে তারা তাদের দখলীয় স্বত্ব জমিতে চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অদ্যবধি।
প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচীতে উপস্থিত বক্তারা সুস্পষ্টভাবে বলেন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নামে বন বিভাগ মধুপুর বনাঞ্চলে আদিবাসীদের নিজস্ব জমিতে রোপিত গাছ, ফসল কর্তন করে যাচ্ছে, পুরাতন বন মামলা নতুন করে পুন:জীবিত করে চলেছে, এবং বিভিন্ন প্রকল্পের নামে এলাকায় অপ্রত্যাশিত অস্থিরতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে দিনের পর দিন, যা অনভিপ্রেত। যার ফলে মধুপুরের এলাকাবাসী শংকিত এবং আদিবাসী অস্তিত্বের মহা হুমকিস্বরুপ বলে উল্লেখ করেন তারা। এছাড়াও তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন সময় সরকার এবং ক্ষমতার পালাবদল হয়; কিন্ত তাদের পরিকল্পনার বদল হয় না। মোদ্দা কথা, সরকার আদিবাসীদের কথা দিয়ে কথা রাখে না। দেশের সরকার, বনবিভাগ আদিবাসীদের মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করে না, তাদের অস্তিত্বকে সংরক্ষণ করতে চায় না। ফলে বক্তারা মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসকারী গারো, কোচ, বর্মনসহ সকল সম্প্রদায়ের প্রথাগত ঐতিহ্যবাহী ভূমি অধিকার রক্ষার জোর দাবি জানান।
এহেন মধুপুর গড়াঞ্চলে সমস্যা সমাধানের ৬ দফা প্রস্তাবনাটি এলাকার নেতা-নেত্রীবৃন্দের সমন্বয়ে তৈরি এবং মধুপুর আদিবাসীদের পক্ষে স্বাক্ষরিত (ইউজিন নকরেক, সভাপতি-জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, উইলিয়াম দাজেল, চেয়ারম্যান-ট্রাইভেল ওয়েল ফেয়ার, মধুপুর শাখা, অজয় এ. মৃ, সভাপতি- জিএমএডিসি, প্রবীর নকরেক, সভাপতি- জলছত্র হরিসভা মন্দির, লিয়াং রিছিল, সাধারণ সম্পাদক- জিএসএফ, সুলেখা ম্রং, নির্বাহী পরিচালক- আ.চিক মি.চিক সোসাইটি, জন জেত্রা, সভাপতি বাগাছাস, গৌরাঙ্গ বর্মন, সাধারণ সম্পাদক- কোচ আদিবাসী সংগঠন, লিংকন ডিব্রা, সভাপতি বাগাছাস, কেন্দ্রীয়, ইব্রীয় মানখিন, গাসু, মধুপুর উপজেলা শাখা এবং মিঠুন হাগিদক, সভাপতি-আজিয়া) হুবাহু কপিটি দেয়া গেলো-
১। ত্রি-দলীয় জরিপের মাধ্যমে (বন বিভাগ, রাজস্ব ও আদিবাসী) আদিবাসীদের ভূমি চিহ্নিত করা হউক, যা ইতিমধ্যে আমরা নিজস্ব উদ্যোগে সম্পন্ন করে রেখেছি।
২। মধুপুর বনাঞ্চলের সংরক্ষিত, জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক ঘোষণাকে বাতিল করে আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনার ব্যবস্থা করা হউক।
৩। ১৯৮২ সনের আতিয়া বন অধ্যাদেশ বাতিল করে আদিবাসীদের রেকর্ড জমির খাজনা নেয়া বন্ধ আবার চালু করা হউক।
৪। স্বত্বাধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় ভূমিসমূহ স্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা হউক।
৫। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে রজ্জুকৃত শতশত মিথ্যা বন মামলাসমূহ ভ্রাম্যমান আদালত সৃষ্টি করে দ্রুত নিষ্পতির ব্যবস্থা করা হউক।
৬। প্রাকৃতিক বন বিনাশকারী সামাজিক বনায়ন বাতিল করে এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের তত্বাবধানে প্রাকৃতিক বন রক্ষার দায়িত্ব তথা কমিনিউটি ফরেষ্ট্রি বা গ্রামবন পদ্ধতি চালু করা হউক।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে নেতারা, মধুপুরের আদিবাসীদের দাবি এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অনতিবিলম্বে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। এছাড়াও আগামী ৩১ জানুয়ারী মহা সমাবেশের ডাক দিয়েছে এবং তাদের দাবি না মানলে এরপর এর চেয়েও আরও কঠোর কর্মসূচী হাতে নেয়া হবে বলে জানান সম্মিলিত আদিবাসী সংগঠন।
স্থানীয় গারো সংগঠন জয়েনশাহী উন্নয়ন পরিষদ, বাগাছাস, গাসু, জিএসএফ, আ.চিক মি.চিক এবং আজিয়াসহ অন্যান্য আদিবাসী অঙ্গসংগঠন সন্মিলিতভাবে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশটি প্রতিনিধিত্ব করেন। (তথ্য সহায়তা-লিয়াং রিছিল, মধুপুর)