লোকটিকে খুব কাছে থেকে দেখি নি। সেই সৌভাগ্য আমার হয় নি। সখ্যতাও ছিল না। কিন্ত তাঁর মৃত্যুর পর থেকে লোকটিকে নিয়ে কেন দু’কলম লিখতে ইচ্ছে হলো জানি না। কিছু ভালো মানুষের জন্যে আমার মনের ভেতর কোণে এমন কিছু দীর্ঘশ্বাস বেড়ে যায় কেন!

দুর থেকে যা দেখেছি এবং তাঁর লেখা পড়ে যা বুঝেছি, সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ধবধবে সাদা জীবন ধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আগাগোড়া রেখে গেছেন অন্যরকম ভাবাবেগ। আজীবন আস্ত শরীরে সেলাইবিহীন সাদা পোশাক জড়িয়ে কাটান তিনি। মাথায় সরল সোজা সাদা চুল। নিশ্চয় ভেতর মনটাও সাদা ছিল ! মন সাদা না হলে তাঁর সকল কর্মে সাদা মনের ভাব কিভাবে প্রকাশ ঘটাতেন? অনেকেই বলতেন তিনি অনেকটা মহাত্মা গান্ধীর ভাব ধারায় চলতেন। বলুনতো এ যুগে এভাবে কতজন পারেন?

সৈয়দ আবুল মকসুদ ছিলেন একজন অ্যাকটিভিস্ট। বাঙালী, অবাঙালি নাগরিক স্বার্থে আজীবন লড়েছেন। দেশের সকল আদিবাসী ইস্যূতে তিনি সবসময় রাজপথে সামনের সারিতে থাকেন। রামুতে বৌদ্ধ স্থাপনার হামলার প্রতিবাদে তিনি মিছিল করেছেন, সড়কে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন, পরিবেশ রক্ষায় আন্দোলন করতেন, নদী ও বন রক্ষার জন্য রাস্তায় নামতেন। এমন হয়েছে, কখনো তিনি একাই দাঁড়িয়েছেন রাস্তায়। এদেশের মানুষের অধিকার লড়াই সংগ্রামের সকল বেনার ফেসটুন তাঁর বড় স্বাক্ষী হয়ে আছেন। আর  তাঁর সম্পর্কে খবরের কাগুজে লেখা নাইবা বললেম।

নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁর মৃত্যুতে এক ফেবু স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি  সৎ এবং নির্ভীক। তিনি আরও বলে উদাহরণ দিয়ে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটি বই ঢাকার বইমেলায় উদবোধন করেছিলেন তিনি। কোনও লেখক-বুদ্ধিজীবী এই কাজটি করবেন? আমি নিশ্চিত করবেন না। তাঁরা ভাববেন আমার বই উদবোধন করছেন এটি সরকারের নজরে পড়ে গেলে আবার না সরকারি সুযোগ- সুবিধে পুরস্কার- উপঢৌকন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হন। ভাববেন আমার বই স্পর্শ করে  আবার আমার মতো  ব্রাত্য না  হয়ে যান। হাজার মানুষের ভিড়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ  আমার বইটি তুলে ধরেছিলেন। কোনও দ্বিধা করেননি আমার বই স্পর্শ করতে, ভয় পাননি আমার নাম উচ্চারণ করতে। নির্ভীক ছিলেন তিনি, নির্লোভ ছিলেন। এই চরিত্র আজকালকার বুদ্ধিজীবীদের নেই।‘

তিনি শক্ত হাতে লিখেছেন। আলোচন-সমালোচনা করেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের জীবনীসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবিচ্ছেদ্য নাম। তাঁর লেখা ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য’, ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’, ‘ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু’, ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’, ‘পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রন্নেসা খাতুন’, ‘নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ প্রভৃতি বইয়ে তাঁর গভীর অভিনিবেশ, পরিশ্রম ও মননশীলতার পরিচয় দুর্দান্তভাবে ধারণ করে আছে। শিক্ষাঙ্গনে, এরপর অমর একুশে গ্রন্থ মেলাতেও সরব প্রাণের পদচারণ, এবং তিনি সুপরিচিত একটি মুখ ছিলেন।

উনার মৃত্যুতে দেশবুকের মধ্যে চলছে হাহাকার। এ দেশ হয়তো মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার পর গত এক বছরে বেশিসংখ্যক গুণীজনরা চিরবিদায় নিলেন। আমরা বলি বটে যে, এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়, কিন্তু কথাটার মানে এখন বুঝছি মর্মে মর্মে।

তিনি জীবিত অবস্থায় মুত্যুর কাপন কাপড় পরে সকল মানুষের অধিকার লড়াইয়ে ঝঁপিয়ে পড়তেন। অর্থাৎ সেই যে তিনি সেলাইছাড়া সাদা কাপড় পরা শুরু করলেন, এবং কবর পর্যন্ত সেই কাপড়ই পরে রইলেন। আমার কাছে তাঁর এ মৃত্যু আসলে কোন মৃত্যু নয়, ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করেছেন মাত্র।

এহেন জানতে এবং সবার কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো মানুষ আরেকজন দেখান তো, যিনি সৎ, সুলেখক, প্রতিবাদী ও অ্যাকটিভিস্ট?

এঁরাই প্রকৃত মানুষ। এঁরাই আসলে জগতে সকলের সুখ দু :খ ভালো বোঝেন। মৃত্যুর পরও সৈয়দ আবুল মকসুদ সাদা মনের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন সকলের অন্তরে।

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।