বেলা অবেলায় গল্প না চুকে চলে যায় সবাই; কিন্তু কেউবা আবার বেঁচে থাকে পৃথিবীতে রেখে যাওয়া নিজস্ব অসাধারণ কাজ দিয়ে, অল্প কিছু মানুষ। সেসব গল্প সত্যিই ফুরোবার নয়। সদ্য প্রয়াত গায়ক এন্ড্রু কিশোর এর জন্য গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনান্তে- নাদেরা সুলতানা নদী

আমি আমার ছোটবেলার অনেক বিশ্বাসই আজও যত্নের সাথে লালন করে চলেছি। ইচ্ছে করেই কিছু বিশ্বাসকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেই না! তবে সেই সময় নিজের অজান্তেই মনে মনে ‘ধর্মীয় আচার-আচরণ’ করা মানুষদের বিষয়ে যে ছবি মনে এঁকেছি জীবনের এ বেলায় এসে তা নূতন করে খুঁজে ফিরতে বাধ্য হচ্ছি। খুঁজি, পাই না ফিরে আর অনেক অনুভব, আর বিশ্বাস!

অবুঝ বেলায় দেখা এবং জানা কোন এক ‘হাজী চাচা’ সবার সব কাজের যিনি ছিলেন ভালো পরামর্শক এমন হয়তো কতদিন হয়েছে চাচা ভোরে নামাজ পড়ে বারান্দায় ‘তজবী’ হাতে বসেছেন, উনার সাথে দেখা হলেই মনে হত ‘দিন আজ ভালো যাবে’! পাড়ার যেকোন অনাচারে কোন সু-পরামর্শের দরকার হলে সেই মানুষটা বিশাল একটা ভরসা হয়ে দাঁড়াতেন বারবার। ছোট বেলায় মনের গভীরে আঁকা ‘ধর্মীয় আচার করা ভালো’ মানুষ মানেই আমি মনে করতাম আপাদমস্তক হাসিখুশী নির্লোভ নির্বিরোধী সরল কোন মানুষ! (হায় বিশ্বাস)

সেই অবুঝ সময়ই পাড়ায় থাকা কোন এক বিধবা মাসীমা যার জীবনের ব্রতই ছিল পিতাহীন পাঁচ ছেলে-মেয়েকে ‘লালন পালন করে বড় করা’! হয়তো তাঁর জীবনে বেঁচে থাকার অর্থই ছিল ‘সন্তানের জন্যে বেঁচে থাকা’ সারা দিনমান জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ানো ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষটিও পাড়ার সবার সব ভালো কাজে উত্সাহ দিতেন হাসিমুখেই দরকার হলেই। সেই মাসীমা সন্ধ্যে বাতি জ্বালিয়ে যখন ধুপ ছায়া সন্ধায় তুলসী তলায় দাঁড়িয়ে উনার স্রষ্টাকে স্মরণ করতেন তখনও ধরে নিয়েছিলাম ‘ধর্ম প্রাণ’ মানুষ; ধর্মীয় আচার করা ভালো মানুষ মানেই আপাদমস্তক মমতাময়ী নির্বিরোধী মানুষকে বুকে টেনে নেয়া সরল কোন মানুষ!

পাড়ায় থাকা কোন এক অজিত রোজারীও কাকাবাবু, যার কাজই ছিল অসহায় মানুষকে খুঁজে খুঁজে বের করে সাধ্যমত তার কোন উপকার করা। তখনও মনে হয়েছে, মানুষকে ভালোবেসে তার হাত ধরে কাছে টেনে নেয়াও বুঝি ধর্মীয় আচরণ করা সরল মানুষেরাই সবার আগে করে থাকে!

কি জানি তখন ফেসবুক ছিল না; তাই হয়তো শেয়ার বা লাইক দিয়ে নিজেদের ধর্ম প্রচার করতে না পেরে, ধর্মীয় আচরণ করা মানুষেরা মানুষের মাঝেই মানুষকে ভালোবেসে অন্য সব আচার আচরণের সার্থকতা খুঁজে পেত। ছিল না ঝকমকে কোন লেবাস…।

আজ থেকে সেই কত যুগ আগে শাহ্‌ আব্দুল করিম গান বেন্দেছিলেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা’! আচ্ছা আব্দুল করিমের সেই সময় থেকেই কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হারাতে বসেছিল? উনিও সেই আগে দেখা সরল সহজ সময়ের কথা বলেই হাহাকার করেছেন, আমরাও তো তাই করছি!

তাহলে ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ আসলে কোন সময়কালে ছিল! বাংলাদেশের কোন সময়টায় সব মানুষ বিশ্বাস করতো ‘মানুষের জন্ম পরিচয়ে কোন মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই’ কে নুরুন নাহার বেগম হবে বা নিলীমা সেন, বা নীলম সাংমা হবে তা তাদের হাতে নেই, আর এই নিয়ে কথা বলা একটা অসভ্যতা!

মাঝেই মাঝেই মিডিয়াতে উঠে আসা, আমাদের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে অনেক রকম ছবির নীচে কে কি কমেন্ট করেছে সেটা খুঁটিয়ে দেখা বা পড়ার সাহস বা রুচি কোনটাই হয় না আমার, তবুও চোখ বুলিয়ে যতটুকু জানছি, দেখছি, শুনি খুব বেশী মন খারাপ হয়, তাই এই এলোমেলো ভাবনার অবতারণা।

এটা ঠিক, সময়ের সাথে সাথে পরিবার, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা, আবহ বদলে যায়, বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। এবং এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের স্কুল কলেজ জীবনে বিনোদনের একটা অংশ ছিল রেডিও শোনা। দুপুরে ছায়াছবির গান, সিনেমার এড, বিজ্ঞাপন তরঙ্গ, সৈনিক ভাইদের জন্যে অনুষ্ঠান দুর্বার…।

সকালে প্রভাতী অনুষ্ঠান মহানগর, সপ্তাহান্তে বাংলা নাটক, সন্ধ্যায় বিবিসিতে বাংলা সংবাদ… এই সব ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ (ছিল ধর্ম চর্চাও)!

রেডিও শুনতে শুনতে যারা হয়ে উঠেছিল জীবনের অংশ, প্রয়াত গায়ক ‘এন্ড্রু কিশোর’ তাঁদের মাঝে অন্যতম…।

‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’… আহ কী মায়া।

‘তারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবেনা মন ভরবেনা’… বুঝা না বুঝা সেই হাহাকার!

‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’… না জানা এক অনুভব, জীবন মৃত্যু নিয়ে…

‘বুকেরও ভিতরে রাখিবো তোমারে’… কী যতনেই না প্রেমিক রাখে তার প্রেমকে

‘আমার বুকের মধ্যিখানে’… এইখানে লুকিয়ে রাখা যায় কেউ একজনকেই এবং আর কোনদিন কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা!

‘ভেঙ্গেছে পিঞ্জর, খুলেছে ডানা’… কী তারুণ্যময় সেই কন্ঠ।

সেই জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্জন, মান্না, সালমান শাহ্‌ থেকে রিয়াজ সবাই যেন একটু বেশী নায়ক হয়ে উঠেছিলেন এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠকে ধারণ করেই!

তাঁর কণ্ঠ ইথারে ইথারে বাজবে অনেক অনেক দিন… অন্তত যতদিন আমার মত তাঁর সুরের কাছে ঋণী একজনও বেঁচে থাকবে।

‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’…

গল্প শেষ না করেই চলে যায় সবাই বেলা অবেলায়, কিন্তু কেউ কেউ বেঁচে থাকে পৃথিবীতে রেখে যাওয়া নিজস্ব কাজ দিয়ে, অল্প কিছু মানুষ।

আরো একবার শ্রদ্ধাঞ্জলি, এন্ড্রু কিশোর, আপনার আত্মার শান্তি কামনা করে শেষ করি আজকের লেখা!

যাঁরা পড়লেন, সবার জন্যে ভালোবাসা এবং শুভ কামনা।

নাদেরা সুলতানা নদী, প্রবাসী এবং সংস্কৃতিকর্মী
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
১১ জুলাই ২০২০