নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে আদিবাসী নেই বলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ এই সরকারের নেই বলে মন্তব্য করেছেন লেখক, গবেষক ও কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট (সিডিআই)র পরিচালক থিওফিল নকরেক। ৯ আগস্ট মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পীরগাছা সেন্ট পৌলস হাইস্কুল মাঠে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে তিনি এই কথা বলেন। এ সময় জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদর সভাপতি ইউজিন নকরেকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মধুপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মধুপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার আলম খান আবু।

 বিশ্ব আদিবাসী বর্ষে  আগত গারোসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী 

‘আদিবাসীদের পরিচয় সংকট ও অধিকার: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক বক্তব্যে থিওফিল নকরেক বলেন, ‘স্মরণাতীতকাল থেকে আদিবাসীরা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। খ্রীস্টপূর্ব প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্ব থেকেই আদিবাসীরা এই বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। আর মধুপুর গড়াঞ্চলে আমরা অনেকেই বলি গারো, কোচদের প্রায় ৭০০ বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এইটা না মানলেও রাণী ভবানীর আমলতো মানতে হবে। সেই রাণী ভবানীর আমলও শেষ হয়েছে ২৫০ বছর হলো। এই অঞ্চলে রাণী ভবানীর কাছ থেকে জমি লিজ আদিবাসীরা চাষাবাদ করতো। যদি ২৫০ বছরও ধরি তাহলেও এইটা একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি। ১৯৩৫ সালের আইনে এবরিজিনাল (aboriginal) বলা হয়েছে এবং সেখানে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বেঙ্গল টেনেন্সি এক্ট-এও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এই আইন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারও স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নেই, যারা আছে তারা উপজাতি’, এই ছল চাতুরী করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ এই সরকারের নেই বলে তিনি তার বক্তব্যে মন্তব্য করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘বন বিভাগ ১৯২৭ সালে প্রথম বন আইন তৈরি করে। সেই বন তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটিশরা যাতে এই উপমহাদেশ থেকে নিরাপদে দামী দামী কাঠ পাচার করতে পারে, কেউ জন্য কিছু বলতে না পারে সেই জন্য। বন রক্ষা করার জন্য নয়! আমাদের বুঝতে হবে এটা কোন ধরণের আইন। নতুন বন আইন সংশোধিত হচ্ছে কিন্তু এটাও ওই আইনের অনুবাদ ছাড়া কিছু নয়।‘

যেহেতু হাইকোর্ট থেকে বলা হয়েছে আদিবাসীরা নিজ নামে পরিচিত হতে পারবে সেহেতু গত ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সার্কুলারটি আদালত অবমাননার সামিল, আইএলও কনভেশান (ILO Convention) ১০৭ যদি এখন না মানেন তাহলে এটিও জাতীয় আদালত অবমাননার সামিল বলেও মন্তব্য করেন থিওফিল নকরেক। সার্কুলারটি গোয়েন্দা পরিদপ্তরের সূত্রের ভিত্তিতে জারি হওয়ায় গোয়েন্দা পরিদপ্তরকেও সমালোচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বারবার গোয়েন্দারা নাকি তথ্য দিচ্ছে, বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’বললে আদিবাসীরা বাংলাদেশ দখল করে ফেলবে। তারা ঘুষ দিয়ে দিয়ে নিয়োগ পায় আর এই ভূয়া তথ্যগুলো দেয়। তাদের ব্রেইনের মধ্যে কিছুই নাই। আছে শুধু টাকা আর টাকা।‘

 বিশ্ব আদিবাসী বর্ষে গারো আদিবাসী সাংস্কৃতিক দল

আ.চিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং তিনি বিগত সরকার এবং বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড তুলনা করতে গিয়ে বর্তমান সরকারকে আদিবাসী বান্ধব বলে ভূয়সী প্রশংসা করলে গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন (জিএসএফ) এর সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিল আদিবাসী ইস্যূতে বর্তমান সরকারের সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ডের ওপর তুখোড় জবাব দেন। তিনি কঠোর সমালোচনা করেন গারো নেতাদের। বিভিন্নভাবে সরকারের উল্টো চিত্র তুলে ধরেন। ছাত্র নেতা তিনি তার বক্তব্যে আরও স্পষ্ট উল্লেখ করেন, যে সরকারকে আপনারা আদিবাসী বান্ধব বলছেন দোখলার লেক খনন প্রকল্পটিও বর্তমান সরকারের হাত ধরে আসছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতেও এ সরকার তোড়জোড় চালাচ্ছে অথচ প্রকল্পটির প্রতিবাদ সমাবেশে অনেক সিনিয়র গারো নেতাদের অংশগ্রহণ দেখি না কেন বলেও তিনি প্রশ্ন তুলেন। বর্তমান সরকার আমাদের ভূমিতে আমাদেরকেই (আদিবাসীদের) নিশ্চিহ্ন করার যে পায়তারা করছে এগুলো আমাদের শক্ত হাতে দমন এবং হাতে হাত মিলে, এক সাথে জাতির স্বার্থে কাজ করতে হবে বলেও কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এ ছাত্র নেতা।

এরপর বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) এর সভাপতি জন জেত্রা বলেন, দেশের আদিবাসীদের নিয়ে স্থুলভাবে রাজনীতি হচ্ছে। বর্তমান সরকার আদিবাসী শব্দকে ভয় পায়, কেন ভয় পায় তা আমরা জানি না। জাতিসংঘ কেন আদিবাসী দিবস ঘোষণা করেছেন তা উপলব্দি করতে হবে। সবাইকে গভীরভাবে বুঝতে হবে যে, কেন আদিবাসীদের আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্র আদিবাসীদের সমস্যা মনে করেন। সমস্যা মনে করে বলেই বাংলাদেশে আদিবাসীদের যত সমস্যা। এ সরকার বার্মার রোহিঙ্গাদের রাজকীয়ভাবে, জামাই আদর করে পুনর্বাসন করছেন; কিন্ত আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে সরকার ভয় পায়। এভাবে সমস্যা চলতে থাকলে এবং যদি মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাহলে বাঙালীরাও এ অঞ্চলে টিকতে পারবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেন।

 বিশ্ব আদিবাসী বর্ষে কোচ আদিবাসী সাংস্কৃতিক দল

এ ছাড়ও অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মধুপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান যষ্ঠিনা নকরেক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মধুপুর উপজেলা শাখার মহিলা বিষয়ক সম্পাদক পিউ ফিলমিনা ম্রং প্রমুখ।

সকালে ধূপ জ্বালিয়ে ও পায়রা উড়িয়ে আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন আদিবাসী কালচারাল ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (এসিডিএফ) এর সভাপতি অজয় এ মৃ। পরে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়। র‌্যালিটি পীরগাছা হাইস্কুল মাঠ থেকে শুরু হয়ে দোখলা বাজার প্রদক্ষিণ করে পুনরায় মাঠে এসে শেষ হয়। র‌্যালির পরে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সদ্য নির্বাচিত ভারতের রাষ্ট্রপতি আদিবাসী নারী শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মুর ছবিতে ফুল দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়। এছাড়া মধুপুর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদগুলোর নির্বাচিত আদিবাসী মেম্বার ও সংরক্ষিত মহিলা মেম্বারদেরকেও সংবর্ধনা দেওয়া হয়।