রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে অন্যতম আলোচিত সমরাস্ত্র বা যুদ্ধবিমান এফ-১৬ ফাইটার জেট। সমর বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এফ-১৬ ফাইটার জেট ব্যবহার করলে ইউক্রেন যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে। ফলে সহজে প্রশ্ন আসে, এর কি এমন যাদুকরি বৈশিষ্ট্য আছে যা যুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে ! রাশিয়ার কাছেও আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ ফাইটার জেট বিমান মাথা ব্যাথার কারণ মনে করেন অনেকেই।

জেনারেল ডাইনামিক্স এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন হলো একটি আমেরিকান একক-ইঞ্জিন মাল্টিরোল ফাইটার বিমান যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর জন্য জেনারেল ডাইনামিক্স দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। একটি এয়ার সুপিরিওরিটি ডে ফাইটার হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে, এটি একটি সফল সব আবহাওয়ার মাল্টিরোল বিমানে পরিণত হয়েছে।

এফ-১৬ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম কি, কি ধরনের সমরাস্ত্র তৈরি করে ?

আধুনিক যুদ্ধ বিমান তৈরি করে বিভিন্ন উন্নত দেশ। এর মধ্যে আমেরিকার লকহিড মার্টিন বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। লকহিড মার্টিনের সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির মেরিল্যান্ডে। ২০২০ সালে এর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। শক্তিশালী যুদ্ধবিমান, মিসাইল, রকেট, হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক, বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র নির্মাণ করে লকহিড। বর্তমান বিশ্বে মোস্ট অ্যাডভান্সড ফাইটার জেট হিসেবে পরিচিত এফ-২২ এবং এফ-৩৫ এর নির্মাতা লকহডি মার্টিন। লহহিড মার্টিন তার অধিকাংশ সমরাস্ত্র বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির কাছে। লকহিড মার্টিনের নির্মাণের তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার।

এ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুদ্ধবিমান ছাড়াও লকহিড মার্টিন শক্তিশালী রাডার সিস্টেম, সেন্সর, সাইবার ওয়ার, মহাকাশ মিশন, জলে স্থলে এবং আকাশে সব বাহিনীর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভিলেন্স, এভয়নিক্স, রিকনিস্যান্স, কমিউনিকেশনস সিস্টেম, ইনফরমেশন ফিউশন অ্যান্ড ডেটা অ্যানালিটিক্স, মিসাইল কন্ট্রোল সিস্টেম, ড্রোন বিমান তৈরির সাথে যুক্ত।

Lockheed Martin

এফ১৬ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান  লকহিড মার্টিন, ছবি: বিবিসি

লকহিড মার্টিন বর্তমানে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাইপারসনিক অস্ত্র উদ্ভাবন কর্মসূচীর সাথে। কয়েক দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে। এ হাইপারসনিক মিসাইল বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে ছোড়া হবে। এটি একটি এয়ার লঞ্চড রেপিড রেসপন্স হাইপারসনিক মিসাইল। এটি উদ্ভাবন করেছে লকহিড মার্টিন।

লকহিড মার্টিন যেসব সামরিক বিমান নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-২২ র‌্যাপ্টর ও এফ-৩৫ । এ দুটি বিমানকে বর্তমান বিশ্বের মোস্ট এডভান্সড ফাইটার জেট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

দীর্ঘকাল ধরে সারা বিশ্বে অন্যতম জনপ্রিয় ফোর্থ জেনারেশন সুপারসনিক ফাইটার জেট এফ-১৬ বিমানেরও নির্মাতা লকহিড মার্টিন। এফ সিরিজের আরো রয়েছে এফ-২, এফ-২১ ।

সারা বিশ্বের সেনাবাহিনীতে পরিচিত লকহিড মার্টিনের সি সিরিজের বিভিন্ন সামরিক পরিবহন বিমান। লকহিড মার্টিনের সি সিরিজের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সি-১৩০ হারকিউলিস। সি সিরিজের কমপক্ষে ৪০ ধরনের সামরিক বিমান রয়েছে।

লকহিড মার্টিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টানা ৪২ বছর ধরে এ বিমান সার্ভিসে যুক্ত। এফ-১৬ জঙ্গি বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি। সার্ভিসে যুক্ত হয় ১৯৭৮ সালে। ফিল্ড উইং বিমান হিসেবে বিশ্বের মিলিটারি সার্ভিসে সবচেয়ে বেশি রয়েছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান উদ্ভাবন করেছে জেনারেল ডিনামিকস। ১৯৯৩ সালে এ বিমান নির্মাণ কর্তৃত্ব তাঁরা বিক্রি করে লকহিড মার্টিনের কাছে।

এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬শ এ বিমান নির্মিত হয়েছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে এর নির্মাণ। নির্মাণের পর থেকে এক ডজনের বেশি আধুনিক ভার্সন তৈরি করা হয়েছে এফ-১৬ ফাইটার জেটের । সর্বশেষ ভার্সনের নাম এফ-১৬ভি বা ভাইপার।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের ২৫টি দেশ ব্যবহার করে এ যুদ্ধবিমান। কোনো কোনো দেশের বিমান বাহিনীতে অর্ধেকের বেশি যুদ্ধবিমান হলো এফ-১৬ জঙ্গি বিমান। তাইওয়ানের কাছে রয়েছে ১৪০টি এফ-১৬ ফাইটার জেট। তাইওয়ানসহ বিভিন্ন দেশ সংগ্রহ করেছে শক্তিশালী আধানিক ভার্সন এফ-১৬ ভি। যুক্তরাষ্ট্র ১৩৪টি এফ-১৬কে এফ-১৬ভিতে আপগ্রেড করেছে।

বর্তমানে এফ-১৬ ফাইটার জেট ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য কি এবং কেন এত জনপ্রিয়তা ?

এক কথায় এফ-১৬ জেট একটি বহুমুখী যুদ্ধবিমান। বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি যুদ্ধবিমানের মধ্যে অন্যতম এফ-১৬। আকাশে ওড়ার ৪৭ বছর পরও এফ-১৬ ফাইটার জেট ধরে রেখেছে তার শ্রেষ্ঠত্ব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ব্যয়বহুল এফ-৩৫ বিমান কেনা কমিয়ে নতুন করে এফ-১৬ বিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন কারণে ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয় হতে যাচ্ছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। এ বিমানের শক্তি অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান একটি সুপারসনিক এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস এবং এন্টি শিপ যুদ্ধবিমান। বিশেষ করে এর রয়েছে পারমাণবিক বোমা বহনের ক্ষমতা। এফ-১৬ একটি ফোর্থ জেনারেশন ফাইটার জেট। যুক্তরাষ্ট্র এ বিমান অনেকবার সংস্কার করেছে এবং সর্বশেষ অনেক শক্তিশালী প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে ।

এফ-১৬ জঙ্গি বিমান

এফ-১৬ জঙ্গি বিমান আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে এবং আকাশ থেকে সাগরে মিসাইল নিক্ষেপ করতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে রকেট এবং দীর্ঘ পাল্লার গাইডেড মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা।

পারমাণবিক বোমাসহ প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের বোমা আর মিসাইল বহন করতে পারে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। এফ-১৬ জঙ্গি বিমান বি৬১ এবং বি৮৩ এ দুই ধরনের পারমানবিক বোমা ছুড়তে সক্ষম। ১১টি হার্ড পয়েন্টে ৭ হাজার ৭০০ কেজি ওজনের অস্ত্র বহন করতে পারে।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন সংখ্যা ১টি। এর গতি সুপারসনিক, শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বা ম্যাক-২। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ৩১৮ মাইল। এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের নির্মান ও অপারেশন খরচ অনেক কম। এর ডিজাইন আধুনিক, ইঞ্জিন শক্তিশালী, খুবই হালকা এবং সব আবহাওয়ার উপযুক্ত।

এফ-১৬ একটি এয়ার সুপেরিয়রিটি ডে ফাইটার। এতে রয়েছে এম৬১ ভালকান ক্যানন, সমরাস্ত্র রাখার ১১টি পয়েন্ট । এফ-১৬ বিমানের অফিসিয়াল নাম ফাইটিং ফ্যাকন। তবে এর পাইলট এবং ক্রুদের কাছে এটি অধিক পরিচিত ভাইপার হিসেবে।

বিমানটির দৈর্ঘ্য ৪৯ ফিট ৫ ইঞ্চি। উইং স্প্যান ৩২ ফিট ৮ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৬ ফিট। শূন্যে বিমানটির ওজন ৮ হাজার ৫৭৩ কেজি। ম্যাক্সিমাম টেক অফ ক্ষমতা ১৯ হাজার ১৮৭ কেজি। জ্বালানি ধারণ ক্ষমতা ৩ হাজার ২শ কেজি।

যুক্তরাষ্ট্র এয়ারফোর্সের রিজার্ভ কমান্ড, থান্ডার বার্ডস, ইউএস নেভি, ন্যাশনাল গার্ড ইউনিট ব্যবহার করে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান। বর্তমানে ১ হাজার ৩ শর বেশি এফ-১৬ বিমান যুক্তরাষ্ট্র আর্মির বিভিন্ন শাখায় সার্ভিসে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২৩১টি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান কিনেছে।

কোন কোন দেশে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান রয়েছে ?

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অপর যেসব দেশের কাছে বর্তমানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে সেগুলো হলো পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডান, মরক্কো, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইসরাইল, গ্রিস, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিন কোরিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, চিলি, নেদারল্যন্ড নরওয়ে, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, ভেনিজুয়েলা এবং তাইওয়ান। ইতালীও এক সময় ব্যবহার করেছে এ বিমান।

সমর যুদ্ধে এফ-১৬ এর চাহিদা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।  সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিপুলসংখ্যক সর্বাধুকি প্রযুক্তিসম্পন্ন এফ-১৬ বিমান কিনতে যাচ্ছে। প্রাথমিক অধ্যায়ে ৯০টি আধুনিক এফ-১৬ বিমান সরবরাহ করা হবে।

গোটা বিশ্বে এফ-১৬ জঙ্গি বিমানের নাম খুবই পরিচিত। এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে আলোচনায় আসে এ যুদ্ধবিমানের নাম। কারণ, পাকিস্তানের কাছে থাকা এ বিমানের কারণে ভারত বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।

ফলে চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেনস্কি বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকে এর গুরুত্ব অনুধান করে পশ্চিমা মিত্রদের কাছ এফ-১৬ চেয়ে আসছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রাশিয়াকে প্রতিহত করার অন্যতম হাতিয়ার মনে করেন জেলেনস্কি বাহিনী। পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনের এ দাবি আমলে নিবেন বলে জেলেনস্কির বিশ্বাস।

এছাড়াও সারা বিশ্বের পাইলটদের অন্যতম পছন্দ এ ফাইটার জেট। এফ-১৬ বিমানে রয়েছে গ্লাস ককপিট। ফলে পাইলট সহজে চারদিকে দেখতে পান।