বিবাহ একটি বন্ধন। বিয়ে হলো একজন নারী ও পুরুষের মিলন। এভাবেই পরিবার থেকে পরিবারের, গোষ্ঠি থেকে আরেক গোষ্ঠীর এবং এক সমাজের সাথে আরেক সমাজের সাথে আত্মীয়তার নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে বিবাহ। গারোদের প্রথাগত বিবাহ রীতিতে এই আত্মীয়তার সম্পর্ক কোন অর্থ-সম্পদ দিয়ে হয় না। আর একারনে গারো সমাজে ‘পণ বা যৌতুক প্রথা বা দেনমোহর’ শব্দটি গারো অভিধানে নেই। গারো সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানেই না যৌতুক কি জিনিস। যৌতুকের কথা শুনলে গারোরা আঁতকে উঠে।

বিশ্বের প্রতিটি সমাজ বা জাতিগোষ্ঠীর বিবাহের রীতিনীতি যেমন রয়েছে, তেমনই গারো সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। গারোদের লিখিত কোন আইন না থাকলেও সমাজের প্রতিটি মানুষের মাঝে যে জাতীয় চেতনা এবং জাতির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে; এই শ্রদ্ধাবোধ, চেতনাসমূহের মাধ্যমেই গারো সমাজ বংশ পরম্পরায় তাদের বিবাহের রীতিনীতি লালন ও ধারণ করে চলেছে দিনের পর দিন।

গারো সমাজের প্রচলিত রীতিনুযায়ী সংসারের যাবতীয় সম্পদের মালিক মেয়েরা বলা হলেও সম্পদ রক্ষণা-বেক্ষণের মূল দায়িত্ব থাকে গোষ্ঠির ওপর। গারো সমাজের দৃষ্টিতে একজন মেয়ে অন্য পরিবারে বা গোষ্ঠীতে বউ যাওয়া মানে তার প্রাপ্য সম্পদ নিয়ে যাওয়া। কোন পরিবার বা গোষ্ঠীই চান না যে সম্পদের মালিক অন্য পরিবারে বা গোষ্ঠীতে চলে যাক। সেকারণেই ছেলেদেরকে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয় এবং স্ত্রীর পরিবার বা গোষ্ঠীর সম্পদের রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্বভার নিতে হয়। ফলে আদি যুগ থেকেই তেমন কোন ব্যতিক্রম না হলে গারোদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হতো কনে বা শ্বশুরবাড়িতে। আর একারনেই হয়তো ‘গারো ছেলেরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাবে বা যায়’ ব্যাপারটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। তবে আধুনিককালের ছেলে-মেয়েরা জামাই যাবে, নাকি বউ আসবে- তারা নিজেরাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। লক্ষ্য করা যায়, আধুনিককালের অভিভাবকরাও তাদের ছেলেমেয়েদের বউ-জামাই যাওয়ার ব্যাপারে আগের তুলনায় অনেকখানি নমনীয়।

বিগত ৩রা এপ্রিল ২০১৮ দ্যা দেইলি বিডি ডট কম-এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের যেখানে মা-মেয়ে বিয়ে হয় একই পুরুষের সঙ্গে!’ শিরোনামটি আমার গোচরে আসে। শিরোনামটি আমার জানা মতে, বিষয়টি সোস্যাল মিডিয়ায় তুমুল ঝর তোলে। পাশাপাশি যদ্দুর মনে পড়ে, এক ইউটিউব ক্রিয়েটরের বিরুদ্ধে ভিডিওটি বন্ধের অভিযোগ করা হয়েছিল ইউটিউব কর্তৃপক্ষকে। প্রতিবেদনটি একটি জাতিসত্তার আদি প্রথাকে হেয়ালিভাবে খাটো করেছে। এমন দৃষ্টিহীন প্রতিবেদকের প্রতিবেদনটি অত্যন্ত বেদনা দায়ক এবং আমার কাছে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে।

অ-আদিবাসীরা গারো প্রথাগুলো তুলে এনে মুখরোচক প্রতিবেদন, ইউটিউব ভিডিও বানিয়ে ধোঁয়শা তৈরি করে গ্রাহক বাড়তে পারে। মনগড়া প্রতিবেদন, আখ্যা কিংবা ব্যাখ্যা দিলেই রীতিসিদ্ধ হয়ে যায় না। হতে পারে না। প্রসঙ্গটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিধায় এমন প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে আপনারা নিজেদেরকে ঝালিয়ে নিন। ঝালিয়ে নেয়াটা অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। প্রসঙ্গক্রমে গারোদের প্রথাগত দুটো বিয়ে রীতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। আসলে কেন গারো প্রথায় জিকগিদ্দি রা.আ এবং  চাপ্পা বা অনচাপা বিদ্যমান এবং তা আসলে কার জন্য প্রযোজ্য।

তো এবার চলুন গারোদের প্রথাগত দুটো বিয়ে রীতিগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। প্রথাগুলো প্রাচীন। আর খুব বেশি আজকাল দেখাও যায় না। প্রথাগুলো আপনার কাছে অদ্ভুত, হাস্যকর মনে হতে পারে। আপনার কাছে অদ্ভুত, হাস্যকর মনে হলেও; এর পেছনে যৌক্তিক বিষয়ও আছে বৈকি! বিয়েগুলো যেমন-

জিকগিদ্দি রা.আ- শাব্দিক অর্থ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ। স্ত্রী যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের কথা ভেবে চ্রাগণ অর্থাৎ মামা, ভাইদের দল সেই পুরুষ/স্বামীর জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়ার অনুমতি দেন। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে বাধ্য বাধ্য করা হয়। এছাড়াও স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে পঙ্গুত্ব এবং স্ত্রীর মৃত্যুবরণ করলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে হয়। তবে যে কারণেই দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়া হোক না কেন, দ্বিতীয় স্ত্রীটি প্রথম স্ত্রীর গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন। যেমন, স্ত্রী যদি চিরান হয়, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীও হতে হবে চিরান মা.চং পরিবারের। এভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়াকেই জিকগিদ্দি রা.আ বলা হয়।

চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা- চাপ্পা, অনচাপা বা দকচাপার বাংলা অর্থ হচ্ছে একটার সাথে আরেকটা দিয়ে দেওয়া। উপযুক্ত কোন পুরুষ বা মহিলা বিধবা অথবা বিপত্নীক হয়ে থাকবে- এটা গারো সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু, অপমানজনক। কারোর স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে সে সামাজিক (আখিম) আইনের মাধ্যমেই স্বামী/স্ত্রী দাবী করতে পারে। যদি পুরুষ/স্বামী মারা যান, তাহলে স্বামীর আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্বামীর পরিবর্তে স্বামী দিতে না পারে। স্ত্রী মারা গেলেও একইভাবে আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্ত্রীর পরিবর্তে স্ত্রী দিতে না পারে। তাই মধ্য বয়সে কারোর স্বামী মারা গেলে আর উপযুক্ত বা সমবয়সের পুরুষ পাওয়া না গেলে এবং ঐ মধ্য বয়স্কার জন্য দ্বিতীয় স্বামী হিসাবে তরুণ-যুবককে দিতে হয়। এমতাবস্থায় এই তরুণ স্বামীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কম বয়সী মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে নির্বাচন বা দেওয়া হয়- এই পদ্ধতিটাকেই চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা বলা হয়।

তো কথায় অনেক কথায় চলে আসে। এই ধরুন- বহুবার লক্ষ্য করেছি কিছু অ-আদিবাসীদের লেখায় বেশ ভুলভাল তথ্য, মনগড়া বিশ্লেষণ, তথ্য পরিবেশন, গ্রন্থ প্রকাশ দেখেছি; যা অনভিপ্রেত। অ-আদিবাসীরা বাংলায় গারোদের নাম বা পদবি লিখতেও কলম ভাঙ্গে এও অবশ্য নতুন নয়। চিরান’কে চিরাং বা চিডাং, নকরেক’কে নরেক, চিসিম’কে চিজিম, পজন’কে ফজন ইত্যাদি। তাঁদের এমন লেখা দেখলে নিজেই হাঁসি, বিব্রতকর লাগে। গারোদের অলিখিত প্রথা না জেনে, না বুঝে অ-আদিবাসী লেখক কিছু লিখলে আরও কীসব ভুলভাল হতে পারে এবার আপনিই বিষয়টি একটিবার ভাবুন তো!

অ-আদিবাসী লেখক, প্রতিবেদক যে বা যারা অযৌক্তিকভাবে লেখেন, লেখার খাতিরে লেখেন কিংবা মনগড়া ব্যাখ্যা দিলেই লেখকের দায়িত্ব শেষ তা কিন্ত নয়; পাঠককে বিষয়টি গভীরভাবে বুঝার এবং সঠিকভাবে অনুধাবনের বিষয়টিও আপনারই হাতে ন্যস্ত। এতে করে আপনি যেমন পাঠককে বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হবেন; তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকে সুনিশ্চিতভাবে বাঁচাতে পারেন। তাকেই আমরা বলবো দায়িত্বশীল লেখক কিংবা প্রতিবেদক, পেশাদার সাংবাদিক।

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী ।