মূলত একটি দেশের এবং নির্দিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে ঋতু পঞ্জিকা তৈরি হয়। বাংলাদেশে ঋতুকে ৬টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে, যেমন – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। সকল ঋতুর বিরাজকাল সমান না হলেও হিসাবের সুবিধার্থে পঞ্জিকা বৎসরকে সমমেয়াদী কয়েকটি ঋতুতে বিভাজন করা হয়।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ঘেটে জানা যায়, গারোদের পঞ্জিকার হিসাব মূলত কৃষি ভিত্তিক। গারো ভাষায় যেমন সংখ্যা গণনা রয়েছে, তেমনই সারা বছরের (বিলসিকারি বা সলেতক) জুম চাষের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের নাম; অর্থাৎ দিন, সপ্তাহ, মাস ও ঋতু, কাজের নাম এবং কৃষি উৎসবের নাম রয়েছে। গারোদের নিজস্ব ভাষাতেও দিন, মাসিক, ও ঋতু পঞ্জিকা রয়েছে, যেমন- 

গারো ভাষায় দিন পঞ্জিকা-

গ্রিসো (Griso) – সোমবার

আবেসো (Abeso) – মঙ্গলবার

আইরো (Airo) – বুধবার

মে’চো (Mecho) – বৃহস্পতিবার

নারিংসো (Naringso) – শুক্রবার

সানিচো (Sanicho) – শনিবার

চিগিচো (Chigicho) – রবিবার

 

গারো ভাষায় মাসিক পঞ্জিকা-

গালমাকজা (Galmak ja) – মার্চ

মেবাকজা (Mebak ja) – এপ্রিল

জাগ্রোজা (Jagro ja) – মে

সগালজা (Sogal ja) – জুন

জাগাপজা (Jagap ja) – জুলাই

জামেদকজা (Jamedok ja) – আগস্ট

মেপাংজা (Mepan ja) – সেপ্টেম্বর

আনিজা (A’ni ja) – অক্টোবর

বেরকজা (Berok ja) – নবেম্বর

কিলকজা (Kilok ja) – ডিসেম্বর

আউইতজা (Awit ja) – জানুয়ারি

ওয়াচেংজা (Wacheng ja) – ফেব্রুয়ারি

১)   গালমাক জা (Galmak ja): মার্চ মাস। গারোদের কাছে এটি বছরের প্রথম মাস। অনেকের মতে ফেব্রুয়ারি মাসের অর্ধেক এবং মার্চ মাসের অর্ধেক অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে চৈত্রমাস। এ মাসে নববর্ষ উৎসব উদযাপন করা হয়। আসং কোশির (গ্রাম ও জীবন রক্ষক দেবতার) পূজা করা হয়। এ কৃষি সময়কে আসকারী বলা হয়। এ মাসের কৃষি উৎসব হলো ‘দেন বিলসিয়া’ (নতুন কৃষিজমি পরিষ্কারের উৎসব)। গিৎচিপং, মিচিল থাত্তা ইত্যাদি বহু সংখ্যক উৎসব এ মাসে হয়ে থাকে।

২)   মেবাকজা (Mebak ja): এপ্রিল মাস। এটি বৎসরের দ্বিতীয় মাস। এই মাসে কৃষি সময়ের নাম হলো গালমাক বা গেআ কারি। এ মাসে আসিরকা বা আসি অক্কা কৃষ্টি উৎসব হয়। আসি অক্কা অর্থ মন্দ শক্তির প্রভাব দূর করা। এ মাসে পাহাড়ি ধান বোনা হয় এবং সামদিম/সামদুম দাঙা বা আগাছা নিড়ান হয়।

৩)   জাগ্রোজা (Jagroja): জাগ্রোজা গারো পঞ্জিকার বৎসরের তৃতীয় মাস। অর্থাৎ মে মাস। এ কৃষি সময়ের নাম হলো জাকরাকারি। এ মাসে নতুন কৃষিক্ষেত নিড়ান হয় এবং একে কেন্দ্র করে আ-জাকরা উৎসব পালিত হয়।

৪)   সগালজা (Sogalja) : বৎসরের চতুর্থ মাস; জুন মাস। এ কৃষি সময়ের নাম হল দাংকারি। এ মাসে দ্বিতীয় বছরে ব্যবহৃত কৃষি ক্ষেত নিড়ান হয়। এর নাম আব্রংদাংআ। এ মাসে ভুট্টা (মিকপ) ফসল তোলা হয় এবং আব্রেং দাঙা উৎসব পালিত হয়।

৫)   জাগাপজা (Jagapja) : জাগাপজা অর্থাৎ জুলাই মাস হচ্ছে গারো পঞ্জিকার বৎসরের পঞ্চম মাস। এ কৃষি সময়ের নাম হলো মিসিকারি। এ মাসে বামিল (দ্বিতীয় ফসলের জন্য নতুন করে চাষ) এবং আব্রেংরাত্তা হয়। মিসি বা মিসিরি (কাউন), মিখপ (ভুট্টা) তিল এবং অন্যান্য শস্যও এ সময়ে কাটা হয়। এ মাসে ‘মি’ আমুয়া বা রক্ষিমের (শস্য দেবী) পূজা উৎসব হয়।

৬)   জামেদকজা (Jamedokja) : বৎসরের ষষ্ঠ মাস; আগস্ট মাস। এ কৃষি সময়ের নাম হলো মিত্তেকারি। এ মাসে সামাংদাংআ বা আগাছা নিড়ান হয়। এ মাসে গ্রীষ্মকালীন ফসল তোলা শেষ হয় এবং রংচুগালা, গিন্দেগাল্লা বা মিগিত্তাল উৎসব পালিত হয়।

৭)   মেপানজা (Mepanja) : মেপানজা; বৎসরের সপ্তম মাস। ইংরেজী ক্যালেণ্ডার অনুসারে সেপ্টেম্বর মাস।এ কৃষি সময়ের নাম হলো সামপাংকারি। এ মাসে গারোরা আগাছা পরিস্কার করে।

৮)   নিজা (Anija) : বৎসরের অষ্টম মাস; অক্টোবর। এ কৃষি সময়ের নাম ওয়াছি ছাকাতকারি। এ মাসে গারোদের প্রধান উৎসব ওয়ানগালা ও ঘুরে ওয়াতা উৎসব উদ্যাপিত হয়।

৯)   বেরকজা (Berokja) : বৎসরের নবম মাস। অর্থাৎ নবেম্বর মাস। এ মাসে কার্পাস ফসল তোলা হয় এবং আ’বিয়া উৎসব পালিত হতো।

১০) কিলকজা (Kilokja) : কিলকজা বছরের দশম মাস। ডিসেম্বর মাস। এ মাসে আখিং নকমা (রাজা) আ’দাল (নতুন জমি) চাষের জন্য বিতরণ করা হতো এ মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো উৎসব নেই।

১১) আউইতজা (Awitja) : বৎসরের একাদশ মাস আউইতজা অর্থাৎ জানুয়ারি মাস। এ মাসে নতুন জমি পরিষ্কার করার কাজ আরম্ভ করা হয় এবং অ’পাতা উৎসব পালন করা হয়।

১২) ওয়াচেংজা (Wachengja) : এ কৃষি সময়ের নাম ওয়াচেংজা। এটি বছরের বৎসরের দ্বাদশ মাস, ফেব্রুয়ারী মাস। এ মাসে বরাং তৈরি করার সময়।

গারো ভাষায় ঋতু পঞ্জিকা-

বালরোরোখারি (Palinkhari) – বসন্তকাল

দিং’খারি (Dingkhari) – গ্রীষ্মকাল

ওয়াচি’খারি (Wachikhari) – বর্ষাকাল

আ’রাক’খারি (A’rakkhari) – শরৎকাল

পিলানখারি (Bandonkhari) – হেমন্তকাল

সিন’খারি (Sinkhari) – শীতকাল

গারো ভাষায় ‘জা’ মানে মাস। তাদের নিজস্ব ভাষায় সেগুলোর ব্যবহারও অতি প্রাচীন। গারোদের মাস শুরু মার্চ মাস থেকে। ফলে বছরের শুরু থেকে সারা বছর বিভিন্ন উৎসবও পালিত হতো নিজেদের ঋতু পঞ্জিকায়। বিভিন্ন কৃষিজ ফসল, চাষাবাদ, সংরক্ষণ ইত্যাদি হতো সে ঋতু পঞ্জিকানুসারে। তথ্যসূত্র: গারো সংস্কৃতির মাধুর্য (প্রকাশিতব্য)

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী, lchiran76@gmail.com