ইংরেজীতে প্রবাদ আছে ‘টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নো ম্যান’। ঘড়ির কাঁটা যেমন থেমে থাকে না, তেমনি মানুষের জীবন-জীবিকা, চলার গতি-প্রকৃতিও থেমে নেই। মানুষের চলা-ফেরা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার বিস্তর ফারাক থাকে, ভবিষ্যতেও থাকবে। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার পথ ধরে একা। আমাদের জীবন থেকে প্রতিটি মুহূর্তেই জীবন থেকে একটি একটি করে সেকেন্ড হারিয়ে যাচ্ছে, তা কি কখনো আমরা ভাবি?
যারা জীবনকে গড়তে চায়, রঙিন করে সাজাতে চায় তারা ঐ সফল ব্যক্তিদের জীবন, তাদের ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে আমরা কতটুকুইবা জানি? তাদের চলার গতিবিধিগুলো আমরা কি কখনো অনুসরণ করি? আজ যারা ঘড়ির কাঁটায় সেকেন্ড ধরে ধরে চলতে পারে, তারাই জীবনকে রাঙাতে পারে, তারাই একসময় সাফল্যের মালা গলায় পরে। জীবন সাফল্যের শীর্ষে পা রাখে। তারাই রাজ পথে প্রতীকী, ভাস্কর্য হয়ে উঠে।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে রাঙিয়ে জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নামই সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের গল্প একেকজনের একেক রকম। মানুষ আর মননভেদে নানা রকম হয়ে থাকে। কল্পিত কল্পে জীবন সাজানোর গল্প একেক জনের গল্প একেক রকম হলেও সবার জীবন সামনে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে।
শুরুতে বলছিলাম, সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না, অপেক্ষা করে না। ফলে জীবন সাফল্যে কেউ বা ধীরে আবার কেউ বা দ্রুত-সবাই সামনে এগোনোর প্রচেষ্টায় প্রহর গুনছে। অতীত কিংবা বর্তমান জীবন থেকে আমরা কিছু বাস্তব শিক্ষা নিতে পারি। অর্থাৎ যে যত দ্রুত বাস্তব জীবন থেকে শিক্ষা নিবে, সে তত বেশি সাফল্যের দৌড় গোড়ায় পৌছাতে পারবে।
এহেন মানুষের জীবন থেকে নেয়া কিছু ঘটে যাওয়া গল্প, স্মৃতিগুলো শেয়ার করা যেতে পারে। সেগুলো কারোর জীবনের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলেও যেতে পারে, তবে তা হতে পারে কারোর জন্য শিক্ষা, কিংবা প্রেরণা। নিজেকে আত্মমূল্যায়ন করে সঠিক পথ অনুসরণ করতে এবং একটি সুন্দর জীবন পেতে সহায়তা করতে পারে, যেমন-
আমরা সোস্যাল মিডিয়ার জীবন পার করছি। আর মনে করেছি এটিই আমার শ্রেষ্ঠ পাওয়া। শিক্ষাসহ দুর থেকে জানা অজানাক শেয়ার করতে পারি, একে ওপরকে আপন করতে পারি, বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারি ইত্যাদি.. এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে! ফলে একটা সময় আমরা মনে করি আমাকে ছাড়া সোস্যাল মিডিয়া পুরো অচল, সোস্যাল মিডিয়া আপনাকে ছাড়া আড্ডা ভালো জমে না। এমনটি ভাবা আপনার ভুল ধারণা। আপনি সোস্যাল অঙ্গনে না থাকলেও ওসব সোস্যাল মিডিয়া আপন গতিতেই চলবে এবং এটাই বাস্তবের বাস্তব সত্য। সময়, অর্থ অপচয় নয়, বরং স্যোস্যাল মিডিয়া থেকে আত্ম নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো রপ্ত করুন।
স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হতো সমিতি, সংগঠন, সামাজিক উন্নয়ন নিজের হাত দিয়ে গড়তে হবে। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে করতে হবে। সামাজিক ভালো কাজগুলো করতে গিয়ে মতভেদ হয়েছে, আমরা দেখেছি অনেক সুযোগ সন্ধানী বহুরুপী মানুষ। দেখেছি আমরা অনেক রাক্ষসী ছোবল। ঠিক তখনো মনে হতো সামাজিক, দেশের উন্নয়ন আপনাকে ছাড়া হবে না। আপনি ভেবেছেন আপনার মতোন সবাই সৎ, সততা, নৈতিকতা নিয়ে চলে। এসব সবই ভুল ধারণা। আপনি ছাড়াও সামাজিক উন্নয়ন, উন্নতি হবে এবং হচ্ছে… তবে যতটা হবার কথা ছিল সেভাবে হচ্ছে না। তারা আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করবে ; কিন্ত সে কাজগুলো আপন গতিতে চলতে থাকবে। ফলে আবেগ নয় বরং বাস্তববাদী হতে শিখুন।
সামাজিক, পারিবারিক কোনো কিছুই জীবনে চিরস্থায়ী নয়। কারোর আবেগ, অনুযোগ কিংবা অভিযোগ-কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সামাজিক সম্পর্কগুলো সব সময়ই এক রকম যাবে না। আজ আপনার কাছে যাকে ভালো লাগছে, কালকে তাকে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। আজ যিনি অন্ধ হয়ে আপনাকে প্রশংসা করছেন, কাল তিনি আপনার বিরুদ্ধে আঙ্গুল উচিয়ে সমালোচনা করতে দ্বিধা করবে না এবং সেটাই আজকের বাস্তবতা। মিথ্যের সঙ্গে আপোষ নয় ; ভালো সিদ্ধান্ত নিতে শিখুন, সেভাবে কাজ করুন। ভালো কাজে বাঁধা থাকলেও সফলতা একদিন আসবেই।
সততা মানুষকে জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়। এর মধ্যে অন্যরকম সুখ অনুভূত হয়, যা পৃথিবীর অন্য কিছু সঙ্গে মেলানো যায় না। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ আপনাকে সাময়িক আনন্দ দিবে, উপচে পড়া অর্থ দিবে; কিন্ত আনন্দ চিরস্থায়ী নয়। সঠিক উপায়ে অর্জিত অর্থ সামান্য হলেও আপনাকে দিবে অসামান্য, অনিন্দ পার্থিব্য সুখ।
অর্থ ধার দেয়া কিংবা অন্যের কাছে ধার নেয়ার অভ্যাস, ঋণে নিজেকে কখনোই জড়াবেন না। আজীবন চেষ্টা করুন নিজের হাতে এবং সৎ উপায়ে আয় করতে। যতটা আয় করবেন, তা বুঝে ব্যয় করতে শিখুন। সামাজিক দায়বদ্ধতা মনে করে অর্থ ধার দিতে গিয়ে, বা ধার নিতে গিয়ে সময় মতো পরিশোধ করতে না পারলে গাঢ় সম্পর্ক ছিন্ন হতে পারে।
প্রয়োজনের বাইরে এবং দামি জিনিসপত্র কেনা থেকে বিরত থাকুন। খুব সাধারণ মানের বস্তু ব্যবহারের অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করুন এবং সন্তুষ্ট থাকুন। দামি বস্তু যতটা আনন্দ মেলে হয়তো মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা আরও আনন্দ দেবে। বস্তুগত আনন্দের চেয়ে অভিজ্ঞতা, স্মৃতি জমানোর দিকে মনোযোগ দিন।
পেশি শক্তি এবং শুধু পরিশ্রমেই জীবনে সাফল্য আসে না। পরিশ্রমের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে লাগিয়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সাফল্য পেতে হয়। বছরের পর বছর একই কাজ করতে করতে জীবনকে কখনোই একঘেয়েমির বৃত্তে আটকে ফেলবেন না। যেকোন ভালো সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিতে শিখুন। ঝুঁকি নেওয়ার একটা সুবিধা হচ্ছে, আপনি জানেন না সামনে কী আসবে। এই অচেনা আর অজানা পথ সামনে নতুন দ্বার খুলে দেয়। এতে আপনি সাধীনভাব অনুভব করবেন, কাজে দ্বিগুন উৎসাহ যোগাবে।
কাউকে প্রতিযোগি মনে করবেন না। পাশাপাশি নিজেকে কখনোই অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে যাবেন না। নিজেকে নিজের সঙ্গে তুলনা করতে শিখুন। আপনার সম্পর্কে অন্যের দেয়া প্রশংসা নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। মিথ্যে প্রশসংসা পেতে অভ্যস্ত না হয়ে বরং নিজে আত্ম মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে তুলুন। দেখবেন আপনি নিজে নিজেই আত্ম বিশ্বাসী উঠছেন।
জীবনে পাওয়া না পাওয়া, সুখ দু :খ সবকিছুকে সাদরে বরণ করতে শিখুন। জীবনে যত বড় দুঃখ অথবা সাফল্য আসুক না কেন সবকিছুকে যেন সঠিকভাবে সামলাতে পারেন ; যেন আবার কঠিন দুর্দিনেও ভেঙ্গে না পড়ি।
সামাজিক জীব হিসেবে সামাজিকতা প্রয়োজন আছে। অতিরিক্তি সামাজিকতা, নৈতিকবোধ চর্চা আপনাকে অর্থনৈতিক এবং মানসিক দুর্বলতাও ভাবতে পারে। তাই পরিমিত এবং সৎপাত্রে দান করা উত্তম।
যা হোক, বাস্তব জীবনের অনেক উদাহরণ, উপমা অনেক দেয়া যেতে পারে। সফল জীবনের গল্প আমাদের সমাজে অনেক আছে। সেসব গল্প, উপমাগুলো নিজের বাস্তব কাজে, সফলে পরিনত করতে পারলে নিজের সফল জীবনের গল্প একদিন একা একাই রচিত হবে।
অতি দ্রুব সত্য কথা, নিজের ভালো মন্দ এবং নিজের পথ নিজেকেই চলতে হয়। অন্যরা আপনাকে দারুণ পছন্দ করে হয়তো, কিন্তু দিন শেষে আপনার পথ আপনাকেই অতিক্রম করতে হবে। অন্যের প্রশংসার জন্য অপেক্ষা করবেন না। নীরবে সামনের দিকে সাধ সাধ্যের মধ্যে কাজ করতে থাকুন। প্রত্যেক মানুষের এগিয়ে চলার গল্প, কষ্টের গল্প ভিন্ন হয়-তাই আপনাকে কেউ এগিয়ে নেবে তা ভেবে কখনোই বসে থাকবেন না। আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মুহুর্ত থেকে শিক্ষা নিন এবং নিজের ভুল শুধরে নীরবে কাজ করতে থাকুন, যার সুফল আপনি একদিন পাবেন।
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।