ড্রাগন ফল বিশ্বে চাহিদা সম্পন্ন দামি একটি ফল। পুষ্টিতেও এর জুড়ি নেই। ফলে ড্রাগন ফল চাষে স্বপ্ন দেখছিলেন টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার পনামারী গ্রামের এক গারো আদিবাসী যুবক মন বেলা। তিনি চাকরীর পাশাপাশি নিজ গ্রামের বাড়ীতে ২০১৬ সালের দিকে প্রায় ১৫ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ড্রাগন চাষ শুরু করেন। চারা লাগানোর এক বছর পর ফলও পেতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তিনি এলাকায় দু’বছর যাবৎ ড্রাগন ফল বিক্রি করতে শুরু করেছেন।

ড্রাগন ফল২

 মন বেলার গড়ে তোলা ড্রাগন ফল বাগান

করোনা মহামারিতে গ্রামে থাকার সুবাদে গেল বছর নিজে খাওয়া, স্বজনদের বিলিয়ে দেয়ার পরও ৮০কেজির বেশি ফল বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য অনুযায়ী ড্রাগন ফল চাষ করতে পারলে প্রচুর লাভ করা যাবে বলে তিনি স্বপ্ন দেখছেন আদিবাসী যুবক মন বেলা।

মন বেলা৩

আ.বিমা টাইসকে তিনি বলেন, কলা বা অন্য ফসল চাষে খরচ, পরিশ্রম বেশি। সেগুলো চাষে প্রচুর লোকসানের ঝুঁকিও রয়েছে। ফলে তাঁর নালিতাবাড়ীর এক বন্ধু সুকুমার সিমসাং এর পরামর্শ পাওয়ার পর নিজের প্রায় ১৫ শতাংশ জমিতে গড়ে তুলেছেন ড্রাগন ফলের বাগান। তিনি আরও বলেন, ড্রাগন চাষ লাভজনক হাওয়ায় এলাকায় তাঁকে দেখে অন্য চাষিরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কলা চাষের পরিবর্তে ড্রাগন চাষ স্বল্প পুঁজিতে, কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফা পেতে পারে বলে তিনি জানান।

ড্রাগন ফল৩

 মন বেলার বাগান থেকে তোলা নতুন ড্রাগন ফুল ও ফল

ড্রাগন চাষ সম্পর্কে তিনি জানান, প্রায় সাত থেকে আট ফুট দূরত্বে কনক্রিটের তৈরি পিলারের চার পাশে ড্রাগন গাছ রোপণ করতে হয়। কনক্রিটের এসব পিলারের উপরে লোহার রডের সঙ্গে সাইকেলের পুরনো টায়ার গোল করে বেধে দিতে হয়। রোপণের পর অন্যান্য ফসলের মতোন খুব বেশি যত্ন নিতে হয় না। কীটনাশাকের ব্যবহারও কম। শুকনো মৌসুমে পানি আর প্রয়োজন অনুসারে অর্গানিক বা জৈব সার দিয়ে পরিচর্যা করতে হয়। রাসায়নিক সার ব্যবহারে উৎসাহী নয়, বরং জৈব সার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছেন তিনি। ফুল আসার পর ঠিক মতোন পরাগায়ন করতে পারলে প্রতি ছ’মাস অন্তর অন্তর ফল পাওয়া যায়। আমি প্রথমবার চারা প্রতি ২০০টাকায় কিনেছি; কিন্ত এরপর চারা নিজেই উৎপাদন করছি। এভাবে এ বছর আরও কিছু নতুন চারা লাগানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি এবং সেভাবে বাস্তবায়ন করছি।

মধুপুর উপজেলার পনামারী গ্রামের ড্রাগন চাষি মন বেলা বলেন, মধুপুরের মাটিতে যেকোন ফসল এবং ফলন ভালো হয়। ড্রাগন ফল আমাদের দেশে এবং এ এলাকায় নতুন কৃষিজাত পণ্য। ফলে এর চাহিদা এবং ড্রাগন ফলের বাজার দর সম্পর্কে আমি ভালো জানি। বাণিজ্যিকভাবে এ ফলের উৎপাদন আমাদের আ.বিমা এলাকায় নেই। সখের বসে কেউ দুয়েকটি গাছ লাগিয়েছে, কিন্ত বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগণ ফল চাষ দেখি নি। আমিও বাণিজ্যিকভাবে শুরু করি নি; তবে আমিই বেশি সংখ্যক চারা লাগিয়ে শুরু করেছি, সে হিসেবে অত্র এলাকায় আমিই প্রথম ড্রাগন চাষি বোধয়। আমি পরীক্ষামূলকভাবে ১৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ১০০টিরও মতোন ড্রাগন গাছ লাগিয়েছি। প্রায় চার বছর আগে নালিতাবাড়ীর এক বন্ধু আমাকে ড্রাগন ফল চাষ করার জন্যে পরামর্শ দেয়। ড্রাগন বাগানের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বন্ধুর পরামর্শ এবং নিজস্ব আইডিয়া থেকে ড্রাগনের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিই। বন্ধুর পরামর্শ ও নিজস্ব আইডিয়ার ওপর ভর করে পরবর্তীতে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, ড্রাগনের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তেমন ভালো ধারণা নেই। ধারণা না থাকার কারণে কেউ কেউ আমাকে নিরুৎসাহিত করতো; কিন্ত আমি হতাশ হয় নি। আমি দেখলাম ড্রাগন গাছ লাগানোর প্রায় ৭-৮মাসের মধ্যে আমার বাগানে ফুল, ফল আসতে শুরু করেছে। গত বছর করোনাকালীন সময় এলাকায় ইতোমধ্যে আমি ৩০০টাকা কেজি দরে দুই মনেরও বেশি ফল বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেছি। বর্তমানে আমার বাগানে বেশ কিছু নতুন গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। ড্রাগন বিদেশি ফল হলেও বর্তমান বাজারে এই ফলের ব্যাপক চাহিদা। স্বল্প কিছু ফলের পাশাপাশি ড্রাগনের চারা বিক্রি করেও আমি বাড়তি আয় করতে পারি বলে তিনি আশাবাদী।

ড্রাগন চারা৫

 ড্রাগন ফল চারা উৎপাদন পক্রিয়া

মন বেলা জানান, দুই বছর বয়সে একটি ড্রাগন গাছে পরিপূর্ণ ফল আসে। ভালোমতোন যত্ন করা গেলে একটি পিলারে প্রতি বছরে ২০ থেকে ২৫ কেজি ফল পাওয়া যেতে পারে। এভাবে বছরে একেকটি পিলারে থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

এছাড়াও ড্রাগন চাষের ব্যয় সম্পর্কে মন বেলা বলেন, আমার ১৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ৮০টি পিলার রয়েছে। এসব পিলার এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছি। প্রতিটি পিলারের গাড়ি ভাড়াসহ খরচ পড়েছে ১৯০ টাকা। আমার ১৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ১০০ শত চারা রয়েছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে (নতুন চারা, পিলার এবং জৈব সার) পুরো জমিতে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চারা লাগানোর পর গেল দুই বছরে প্রায় ২৫ হাজার টাকাও বেশি ফল বিক্রি করেছি, যা আমার কাছে সত্যিই অবিশ্বাস্য। এ বছর আরও পুরাতন এবং নতুন গাছে ফুল ধরেছে, ফলনও ভালো পাবো বলে আশা করছি। তাছাড়া ড্রাগন ফল চাষ কলা চাষের মতোন নয় যে প্রতি বছর আবার নতুন করে গাছ রোপণ করতে হবে। ড্রাগন গাছ একবার রোপণ করলে যত্নের মাধ্যমে অনেক বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া সম্ভব।

ড্রাগন ফলের চাষ পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, ড্রাগন চাষে পূর্বে অভিজ্ঞতা নেই। কৃষি কাজের অভিজ্ঞতা এবং ইউটিউবে ড্রাগন চাষের ভিডিও দেখে নিজে থেকে শুরু করেছি। প্রথমে ভালো করে জমি চাষ করতে হবে। চারা রোপণের কয়েকদিন পূর্বে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে জৈব সার দিয়ে নিতে হবে। এরপর হাফ ইঞ্চি কম মাটিতে চারা রোপণ করতে হবে। একটি পিলারে তিনটি অথবা চারটি ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করা যায়। এক পিলার থেকে অন্য পিলারের দূরত্ব সাত ফিট রাখতে হবে।

ড্রাগন ফল৬

  ড্রাগন ফল বাগানে নতুন আসা থোকা থোকা ফুল 

তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত আমি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছি। বাণিজ্যিকভাবে করতে চাইলে কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তা নিতে পারলে আরও ভালো বলে তিনি জানান। ড্রাগন ফল চাষ করতে জৈব সার বেশি প্রয়োজন হয়। জৈব সার বাজার থেকে না কিনে নিজে ভার্মি কম্পোস্টের মাধ্যমে জৈব সার তৈরি করতে পারি। তাতে খরচও কম হয়। ফলে সেখানে অধিক লাভের সম্ভাবনা থাকে।

ড্রাগন ফলে লাভবান হাওয়ায় স্থানীয় গারো আদিবাসীসহ বাঙালীরাও ড্রাগন চাষে উৎসাহি হচ্ছেন বলে তিনি জানান।