বাহ্যিকভাবে সুন্দর ধবধবে চেহারা, এবং লম্বা আকর্ষণীয় দৈহিক গড়নের অধিকারী হলেই অতুলনীয়, অসাধারণ, ব্যক্তিত্ববান মানুষ বলা যাবে না। লোক দেখানো, অন্যকে ফলো করে নয়। নিজেকে সত্যিকারের ব্যক্তিত্ববান, অসাধারণ করে তুলতে হলে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যই মূখ্য বিষয় নয়। বাহ্যিক সৌন্দর্য্যর পাশাপাশি মানুষের যেসমস্ত ভেতর, বাহির ভালো গুণ রয়েছে সেগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যে ব্যক্তি, এই সুন্দর ভেতর এবং বাহিরগুণকে তার কথায়, দৈনন্দিন কাজে ফুটিয়ে তুলতে পারবে, ফোকাস করবে তখনই একজন ভালো মানুষ বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ একজন ভালো মানুষ সকল দিক থেকে সুন্দর হয়। তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে প্রস্ফুটিত করে। একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্যে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন পরে না। যদি কোন ব্যক্তি ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়কে বুঝতে পারে, সঠিকভাবে মূল্যায়ন এবং অপরকেও মূল্যায়িত করতে পারে, সম্মান করে, সর্বপরি ক্ষমা করতে জানে এটিই একজন ভালো মানুষ হওয়ার প্রধান মূলমন্ত্র।

লোকে বলে দোষ গুণ নিয়ে মানুষ জন্মায়। দোষগুণ নিয়ে জীবন যাপন করে, বাঁচে। তবুও বুঝতে হবে একজন ভালো মানুষ নিজের দোষ গুণ বোঝে, দোষ বা খারাপ বৈশিষ্ট্যকে সংশোধন করে নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য পার্টিক্যুার্লি কিছু গুণাবলীর প্রয়োজন রয়েছে। সেসব গুণাবলী থাকলেই বিচারিক মানদণ্ডে সকল মানুষের কাছে আপনি একজন ভালো মানুষ এবং অতুলনীয়, অসাধারণ ব্যক্তিত্ববান হয়ে উঠতে পারবেন।

এ প্রবন্ধটি আমার ব্যক্তিগত উপলব্দি থেকে লেখা। নিজের মধ্যেও ধারণ করি। আবার লব্ধ জ্ঞানও বলতে পারেন। যা আমার/আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সবসময় কাজে আসে। একটি সমাজে, রাষ্ট্রে ব্যক্তিত্ববান হতে গেলে যা প্রয়োজন-

আত্ম বিশ্বাস রাখুন- নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখুন। নিজের প্রতি যদি নিজেরই আত্মবিশ্বাস না থাকে; তাহলে নিজেকেই কোন কাজে ভরসা করতে পারবেন না। নিজের মধ্যেই সংশয় রয়ে যায়। নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেকে স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলুন। নিজে আত্মবিশ্বাসী না হলে, অন্যরাও আপনার প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগবে। যেকোন সফলতা আত্মবিশ্বাসীদের আলাদাই একটি ব্যক্তিত্বের ছটা থাকে।

গুছিয়ে কথা বলুন- সাধারণত সবাই গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কেউ কেউ সুন্দর করে গুছিয়ে, চমৎকার করে, সাবলীলভাবে টিভি সেটে উপস্থাপনার মতোন কথা বলতে পারে। যেকোন জায়গায়, যেকোন বিষয়ে। কেউ কেউ পারে না তার আবেগ আধিক্য, সংকোচের কারনে। ভয়ে, সংকোচে সুন্দর করে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলে। ফলে আয়ত্ব করুন সুন্দর করে কথা বলার অভ্যাস। আপনি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বললে যে কেউ আপনার কথার মূল্য দিতে বাধ্য। কথা বলার সময় সহজ, সারল্যভাবে কথা বলুন। বাঁকা, বা অতিরিক্ত অযৌক্তিক কথা, পান্ডিত্য দেখাতে যাবেন না। অতিরিক্ত পান্ডিত্য, ম্মার্ট দেখাতে গিয়ে নিজে বোকা বনে যেতে পারেন। সব সময় এবং সকলকে সম্মান দিয়ে কথা বলুন।

বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করুন- আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর লোক থাকে, আছে এবং ভাবেন যে ‘আমার মাথায় বুদ্ধি নেই’। কথাটি আসলে ভুল ধারণা। জেনে রাখুন, এটি হলো নিজেকে ছোট করার বৃথা অস্ত্র, বৃথা অনুনয়। যাকে বলে দুর্বল অভিব্যক্তি। জগতের সকল নর-নারীর সুষ্ঠভাবে জীবন যাপন করা, শিক্ষিত হয়ে ওঠা এবং কাজ করার স্বক্ষমতাই হলো বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। নিজের বিচার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে, সময়কে সঠিক ব্যবহার করলে আপনি দেখবেন আপনার জীবন সাফল।

আবেগ বর্জন করুন- ঈশ্বরের সৃষ্টি নারী পুরুষ কমবেশি আবেগী। তবে পুরুষের তুলনায় জগত সংসারে নারীরা সবসময়ই আবেগী থাকে। একজন নারী যতোই সুন্দরী হোক না কেন তার মধ্যে যদি কিঞ্চিৎ পরিমাণও আবেগ না থাকে তাহলে তার সকল সৌন্দর্য্যই বৃথা। মেয়েলি আবেগ, মায়াবী বৈশিষ্ট আরও অপূর্ব করে তোলে একজন নারীকে। মানুষের বন্ধন, কিংবা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বিষয়ে বা ভালোবাসার প্রতি আবেগী হতেই হবে নারীকে। তবে সব বিষয়ে আবেগ প্রাধান্য দিতে নেই। মানুষের জীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আবেগ বর্জন করলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়ে ‍উঠে।

ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলুন- ব্যক্তিত্ব একটি আপেক্ষিক বিষয়। যা চোখে দেখা, বা ছোঁয়া যায় না। শুধুমাত্র অনুভব করতে পারি। নিজেকে স্বাভাবিকভাবে মেলে ধরার চেষ্টা করুন। কাউকে অন্ধভাবে অনুকরণ, অনুসরণ করে নয়। বরং আপনার কথায়, কাজে এমনভাবে গড়ে তুলুন; যাতে সবাই যেন আপনাকে অনুসরণ করতে চায়। অর্থাৎ স্বাভাবিক বলয়ে থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন। অযথা জোর করে কোন কিছু করবেন না নিজের ওপর। আপনি যা নন তা নিজের ওপর এবং অন্যের ওপর  আরোপ করতে যাবেন না।

কাজে মনোনিবেশ করুন- যখন যে কাজটি করছেন তখন শুধু সেই কাজেই মনোযোগ দিন। দেখবেন একটি কাজের সাফল্য আপনাকে অনেক দুর নিয়ে যাবে। সে সাফল্যে যেমন নিজের প্রতি কাজে আত্মবিশ্বাস জন্মায়, তেমনি অন্যদের কাছে উৎসাহ, প্রেরণার প্রতীকী হয়ে উঠবেন। অর্থাৎ যখন যেখানে আছেন সেখানেই মনোযোগ রাখুন। এভাবেই আপনি নিজেকে শতভাগ ব্যবহার করতে পারবেন।

অনধিকার চর্চা বর্জন করুন- জগতে কিছু মানুষ অনধিকার চর্চা পছন্দ করে। অনধিকার চর্চায় জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে। ফলে নিজের অধিকার সম্পর্কে আগে সচেতন হোন, এরপর অন্যের অধিকারকেও শ্রদ্ধা করুন। জেনে রাখুন অপরকে শ্রদ্ধা করা মানে নিজেকে খাটো করা নয়, বরং সেটা নিজের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধার সহিত অপরের অধিকারের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধাশীল বুঝায়।

সাজ পোশাকে যত্মবান হোন- সব সময় ‘ফরমাল’ বা খুব দামী ব্রান্ডের জিনিস, রং বেরঙের পোশাক পরে সেজেগুজে থাকলেই স্মার্ট বুঝায় তা কিন্ত নয়। আপনার যা আছে তাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকার চেষ্টা করুন। নিজের এবং অপরের স্বাদ ও সাধ্যের প্রতি যত্নশীল হোন, সন্তোষ্ট থাকুন।

প্রশংসা করতে শিখুন- অপরের কৃতিত্বে, ভালো কাজে প্রশংসা করতে শিখুন। যার যা ভালো অর্জন, ব্যক্তি কিংবা জনকল্যাণে আসে তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে স্বীকৃতি দিন। অন্যের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দিতে পারা একজন ব্যক্তিত্ববানের বৈশিষ্ট্য। মন্দ কাজকে দেশ ও দশের স্বার্থে মার্জিত ভাষায় গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনা করুন।

সত্য কথা বলুন- সদা সত্য কথা বলুন। ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করার মতোন হলে শেয়ার করুন। গোপনীয়তা ব্যক্তিত্ববানদের সাংঘর্ষিক একটি চরিত্র। তাই আপনার কথায় সংযত হোন। অন্যায় আচরণ বা অপরাধের দায় স্বীকার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

নৈতিকতা বজায় রাখুন- নৈতিকতা হলো ব্যক্তিত্ববানদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। শারীরিক এবং মানসিকভাবে নৈতিকতা না থাকলে, আদর্শিক জায়গা থেকে ব্যক্তিত্ববান বলা যাবে না।

উদার হোন- উদারতা, ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করুন। অহেতুক নেতিবাচক পোষণ করা থেকে বিরত থাকুন। জাগতিক, আধ্যাত্মিকসহ উদারভাব যেকোন সময় এবং পারিপার্শ্বিকতার জন্য সহনশীল, সহিষ্ণুতা প্রয়োজন।

মতামতকে গুরুত্ব দিন- যৌক্তিক যেকোন বিষয়ে আপনার উপদেশের চাইতে অগণিত দর্শক শ্রোতাসহ আপনার ফলোয়ারদের মতামকে গুরুত্ব দিন।

শেখার মনোভাব গড়ে তুলুন- শেখার কোন বয়স, স্থান কাল পাত্র নেই। ইগো পরিহার করে সাধারণ শ্রোতা হয়ে অন্যের কাছে শেখার মনোভাব অভ্যাসে পরিনত করুন।

ব্যক্তিত্বই হলো সকল নর নারীর প্রকৃত এবং আসল সৌন্দর্য। বাহ্যিক সৌন্দর্য্যই মুখ্য নয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে হলে সকল নর নারীকে নিজ থেকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে হবে।

মোদ্দা কথা- কোন ভেষজ ঔষধি গুণ, এলোপ্যাথিক ভিটামিন কিংবা কবিরাজি কালো যাদু টোনায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না। ব্যক্তিত্ব একটি দীর্ঘ মেয়াদী চর্চা, অনুশীলনের বিষয়। জেনে রাখুন, একমাত্র নিজের আত্মবিশ্বাস এবং সচেতনই পারে আপনাকে ব্যক্তিত্ববান করে তুলতে।

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।