নদীর রুপ যৌবন ঈশ্বর নিজেও বুঝে না। সত্যিইতো নদীর রুপ বুঝা বড় মুশকিল। নদীটি বর্ষায় থাকে অবাক এক প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা, সমুদ্রের যোগ্য সহচারী, রাক্ষুসী, ভয়াল, উত্তাল, আগ্রাসী ও স্রোতস্বিনী। এই নদীর নাম সোমেশ্বরী। লিখতে দ্বিধা নেই, ভারতের ভৌগোলিক মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় প্রাষাণ বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে এক শান্ত ছোট্ট মরা খালে পরিণত হয় নদীটি। আবার নদীটি ভারতে পাহাড়ি ঢলে এবং বর্ষা মৌসুমে হয়ে উঠে বিধ্বংসী সাগর কন্যা। ভারতের এমন মেরুকরণ প্রক্রিয়ার নির্মম, নিষ্ঠুর যাতাকলে আবদ্ধ ও পিষ্ট হয়ে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র নাব্যতা সংকট সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে নদীর বুকে জেগে উঠে বালু চর আর বালু চর। মাইলের পর মাইল বিস্তারকারী ধূঁ-ধূঁ বালুচরের দিকে তাকালে হাহাকার করে ওঠে মন।

শুষ্ক মৌসুমে সোমেশ্বরীর বিস্তৃর্ন জলসীমা সংকুচিত হয়ে যাওয়ার ফলে প্রায় দেশীয় মাছ নি:শ্চিহ্নের পথে! ভারতীয় মেরুকরণের কু-প্রভাবে একদিকে যেমন দেশ বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ হারাচ্ছে, অন্যদিকে স্থায়ী বাসিন্দারা বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙ্গনে হারাচ্ছে বাপ দাদার জমি, শেষ সম্বল ভেটে বাড়ি। শুষ্ক মৌসুম নদী পাড়ের মানুষের পানির অভাবে যেমন তাদের মনে দাগ কাটে; আবার বর্ষা মৌসুমে নদীটি এলাকায় বিষাদে পরিনত হয়।

ফলে বর্ষা এবং শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ এই দুই সিজেনে সোমেশ্বরী বিধৌত এ অঞ্চলবাসীর শুরু হয় দু:খ দুর্দশার পালা। শুস্ক মৌসুমে প্রকৃতি নির্ভর কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের বিস্তৃর্ণ এলাকা হয়ে যায় মিনি মরুভূমি। দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই দেখা যায় ধূঁ-ধূঁ বালুচর। আর বর্ষা মৌসুমে আবাদি ফলস ডুবে থৈ-থৈ পানি আর পানি। মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারত নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রূদ্ধ এবং বাঁধ খোলে দেওয়ায় সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে নদী অঞ্চলগুলো মরুঅঞ্চলে পরিনত হতে চলেছে।

সোমেশ্বরীর নদী তীব্র ভাঙ্গনের ফলে নিম্নাঞ্চলে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে অবস্থান করায় এর মরুকরণের কু-প্রভাব এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে শাখানদীসহ খাল-বিলের গতি প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। সে অঞ্চলে হারাতে বসেছে  অনেক গ্রামীণ ঐহিত্য। নদী পাড় এলাকায় সাধিত হচ্ছে ব্যাপক জান মালের ক্ষয় ক্ষতি।

লেখার শুরুতেই বলছিলাম, সুন্দরী যৌবনা নদীর বুকে কখনোবা দু:খ নেমে আসে তার খবর কেউ আমরা রাখি? নদীর এমন পাড় ভাঙ্গন দেখে, পাড়ের মানুষের দু:খ দুর্দশা দেখে ঈশ্বরও যেন বাক রুদ্ধ, তিনি বনে যান কালা-বোবা।

সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আবার পাড় ভাঙতে শুরু করেছে স্রোতস্বিনী সোমেশ্বরী নদী। নির্ঘুম কাটাচ্ছে নদী পাড়ের সকল মানুষ। তাঁদের চিন্তা চোখের পলকে কখন, কার বাড়ি ধ্বসে পড়ে, কার ভিটা ভেঙে তলিয়ে যায় নদী গর্ভে! এবারে নদীর বিধ্বংসী প্রকোপটি কামারখালি গ্রামে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে। এলাকাবাসীর দু:খ, এ বছরটি একদিকে করোনায় জর্জরিত; আর অন্যদিকে এলাকায় অন্তহীন নদী ভাঙ্গন। এ যেন মরার উপর খরার ঘা। এলাকার যুবকরা দিনরাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার, পাহারা দিলেইবা কি হবে! পাহারাদারদের তীক্ষ্ন চোখ ফাঁকি দিয়ে পেশাদার চুরের মতোন সিঁদ কেটে নদীর বিধ্বংসী ঢেউ ঘরে প্রবেশ করে মালামাল সাবাড় করে, ভিটে বাড়ি তছনছ করে নিমিষেই, সেই খবর কেইবা রাখে !

গারো লেখক ধীরেশ চিরান তাঁর ফেসবুক এক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন এবং তথ্য সম্বলিত কথাগুলো আমার গোচরে আসে- ‘সোমেশ্বরী নদী শীতের সময় প্রায় জীর্ণশীর্ণ থাকলেও বর্ষায় হয়ে উঠে বিধ্বংসী প্রমত্তা। তখন সারা সিমসাং এর বুকজুড়ে পাহাড়ি ঢলে পানি থৈ-থৈ। কৃর্তিনাসা পদ্মার মত নির্বিচারে দু’কোল ভাঙ্গে। উজানের গ্রামগুলো বিধ্বংসী সিমসাংএর করাল গ্রাসে এখন নদী গর্ভে। সিমসাংএর করাল থাবা থেকে রক্ষার জন্য ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে কারিতাস ময়মনসিংহের উদ্যোগে দূর্গাপুর সার্বিক মানব উন্নয়ন সংগঠন রাণীখং থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত নদীর পশ্চিম পাড়ে সিসি ব্লক বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের নিকট আবেদন করে। দুই তিন বছর গণসংযোগ ও সভা মিটিং করে স্মারকলিপি প্রদানসহ স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে এডভোকেসি হয় অনেকবার। অত:পর সরকার ২০০৮ খিস্টাব্দে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সিমসাং-এর পশ্চিম পাড়ে সিসি ব্লক নির্মাণের জন্য ২৫ কোটি টাকা মঞ্জুর করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সিসি ব্লক বাঁধ নির্মাণ হয় ডাকুমারা থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত। বাদ পড়ে যায় উজানে ভাঙ্গন প্রবন গারো অধ্যুষিত গ্রাম রাণীখং, কামারখালি, বড়ইকান্দি ও ভুলিপাড়া। যেখানে পাহাড়ের পানি প্রথমে ধাক্কা লাগে। এখন গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন প্রায়। এরজন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে লেখা লেখিসহ প্রচার হয় এবং মানব বন্ধন করে সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে সিসি ব্লক বাঁধ নির্মাণে সরকারের কাছে দাবী করে এলাকাবাসী। স্থানীয় প্রশাসন প্রায় প্রতি বছর আশ্বাস দেয় সিমসাং পাড়ের মানুষের প্রাণের দাবী বাঁধ নির্মাণে। কিন্তু কবে পুরণ হবে প্রশাসনের সেই আশ্বাসের বিশ্বাস?’

এ সত্য কথাগুলো আমার মনে ভীষণ দাগ কাটে। দফায় দফায় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সকল স্যোসাল মিডিয়াতে খবরগুলো কর্ণগোচর হলেও ঈশ্বরও যেন বোবা-কালা সেজে বসে আছেন। প্রতিনিধিরা জনসম্মুখে বহুবার আশস্ত করে বলেন, বাঁধ নির্মাণ আজ  শুরু করবে, শুরু হচ্ছে, কাল হয়ে যাবে, এবং শুরু হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। আমার কথা হলো, এক এলাকার প্রকল্প সে এলাকায় বাস্তবায়ন না করে কেন আজানা, কোন অশুভ ইঙ্গিতে সরে যায় অন্য কোথাও! জন প্রশাসনে কেন এই লোকচুরি খেলা, কেন এই প্রহসন ! আমাদের ত্রাতা, ঈশ্বর এতো বোধহীন, বধির হন তা আগে আমার জানা ছিল না।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।