একটা সময় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক বা হ্যাকিং বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ছিল। সোজা কথা কারোর একাউন্ট হ্যাক করার কোন কারণ ছিল না। কিন্ত যত দিন যাচ্ছে, ততই মানুষের চিন্তা-চেতনা, বৈশিষ্ট্যে, আচরণে আমুল পরিবর্তন এসেছে। এসেছে অন লাইনের মাধ্যমে নানা ফন্দি-ফিকিরে, অন্যের তথ্য চুরি, এমন কী ব্যক্তির ইমেজ বিভ্রাতের মতোন আপত্তিকর ঘটনাও অহরহ ঘটে এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

প্রযুক্তিগত বিশ্বায়নে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারা মানে পেছনে থাকাই শুধু নয়, নিশ্চিতভাবে আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির অ্যাকাউন্ট সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হবেন। যা শুরুতে বলছিলাম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোটি কোটি সাধারণ ব্যবহারকারী বেড়েছে শুধু তাই নয়। ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসায়িক আর্থিক লাভ বা ব্ল্যাকমেল এ উভয়ের জন্য হ্যাকারদের যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিতি পাওয়া যায়, তারা অবাদে বিচরণ করে। যেমন ধরুন, কোন সেলিব্রিটি কিংবা সাধারণ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সে ব্যক্তির পেজে বা ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য হ্যাক করা যায়।

এ যুগের হ্যাকার বিব্রতকর বা বৈষম্যমূলক পোস্টও পোস্ট করতে পারে; যা কোন ব্যক্তি বা সেলিব্রেটির ভক্তদেরকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। যা বলছিলাম, আপনি খ্যাতিমান না হলেও আপনার অ্যাকাউন্টটি হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিপূর্ণ এবং শঙ্কা থেকেই যায়। অর্থাৎ নান্দনিক সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে আমরা কেউই নিরাপদ নই। যার ফলে আপনাকে অবশ্যই আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি দুস্কৃতিকারী বা হ্যাকারদের হাত থেকে সুরক্ষা করতে হবে। সুরক্ষা করার উপায়গুলো সম্পর্কে এবং আপডেট বিষয়গুলো জানতে হবে।

আপনার অ্যাকাউন্টটি রক্ষা করা এতটা কঠিন নয়। তবে প্রতিরোধক বিষয়গুলো না জানলে আপনার অ্যাকাউন্ট সবসময় আরও ঝুকিপূর্ণ থেকে যাবে। কেবল এই সাধারণ পরামর্শগুলি অনুসরণ করে আপনি আপনার অ্যাকাউন্টটি আজই সুরক্ষা করতে পারেন এবং আপনার তথ্যগুলো নিরাপদে রাখতে পারেন, যেমন-

১) সাইবার ক্যাফ বা পাবলিক ডিভাইসগুলিতে পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবেন না। আপনার পাসওয়ার্ডগুলো কোন ব্রাউজারে সংরক্ষণ না করে, বরং ম্যানূয়ালি কোন নিরাপদ ডিভাইসে সংরক্ষণ করুন। পাসওয়ার্ডগুলি সংরক্ষণের জন্য বেশিরভাগ লোক কেবল পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করুন ডায়ালগ বাক্সে ‘হ্যাঁ’ ক্লিক করে। এভাবে আপনার ডেটা সংরক্ষণ করলে আপনার ডেটা নিরাপদহীন, নিয়ন্ত্রহীন হয়ে পড়বে। এর কারণ হলো ব্রাউজিংয়ের সময় তারা যে ভিড়ের মুখোমুখি হয় সে কারণে তারা তা সঠিক পদ্ধতিতে তাদের ডিভাইসে আপনার পাসওয়ার্ডগুলি কখনো সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে পাসওয়ার্ডটি যেখানেই থাকবে এবং যে কেউ অবশ্যই কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবে।

২) সর্বদা ডিভাইসগুলিতে লগ আউট করে লগইন করুন। আপনার পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ না করা পাবলিক ডিভাইসে হ্যাকিং প্রতিরোধের একমাত্র উপায় নয়। আপনার অ্যাকাউন্ট লগইন রেখে যাওয়ার অর্থই হলো হ্যাকারদের আপনার অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করার পথ প্রশস্ত করা। এমনকি আপনি যদি ব্যবহারের পরে ব্রাউজারটি বন্ধ করেও দেন, তারপরও ফেসবুক সে ডেটা কিছুক্ষণ সংরক্ষণের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। যদি কোনও ব্যক্তি আপনার ঠিক পরে এসে ডিভাইসটি ব্যবহার করে, তবে তা আপনার অ্যাকাউন্টে অ্যাক্সেস থাকার অধিকারটি নিশ্চিতভাবে পেয়ে যাবে। ফলে আপনাকেই নিশ্চিত করতে হবে যে আপনি সে ডিভাইস লগ আউট করেছেন। এর সুবিধা হলো ট্যাবগুলিতে আপনার নম্বর বা ইমেল ঠিকানা পরবর্তী ইউজারের জন্য প্রদর্শিত হবে না।

৩) লগইন এর সময় দুটি উপায়ে বার্তা যাচাইয়ের সুবিধা চালু করুন। বার্তা যাচাইয়ে আপনার মোবাইল ফোনে সেট করুন। এই বৈশিষ্ট্যটি প্রতিবার আপনি বা অন্য কোন ব্যক্তি বা হ্যাকার আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করার চেষ্টা করলে আপনার ফোনে তাৎক্ষনিক একটি প্রমাণীকরণ বার্তা প্রেরণ করবে। আপনি এটি তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার বা ফেসবুকের যাচাই প্রক্রিয়া মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারেন। লগইন করার সময়, আপনি একটি অনন্য কোড পাবেন যা আপনাকে কেবলমাত্র এই সেশনে ফেসবুক অ্যাক্সেস করতে পারমিট করবে। সেশানটি শেষ হয়ে গেলে, আপনার অ্যাকাউন্টটি আরও একবার অ্যাক্সেস করার জন্য আপনাকে আর একটি প্রমাণীকরণ বার্তা গ্রহণ করতে হবে। যদিও দুই পক্রিয়ায় যাচাইকরণে কিছুটা ঝামেলা মনে হতে পারে। একবার ক্লিকে লগইন না করে সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে যাওয়া বেশ অসুবিধাজনক মনে হলেও তবে দু:খবোধের চেয়ে নিরাপদ থাকা ভালো।

৪) আপনার ব্রাউজারটি নিয়মিত পরিষ্কার করুন। যাতে আপনার ব্রাউজারটিতে এবং ডিভাইসে জাঙ্ক ফাইলগুলো দীর্ঘস্থায়ীভাবে অবস্থান না করতে পারে। জাঙ্ক ফাইল বেশিরভাগ ফিশিং প্রক্রিয়া, পর্ন কার্যকলাপ, এবং টরেন্ট সাইটগুলিতে পাওয়া যায়। এসব বাচ-বিচার না করে আপনি যদি প্রায়শই দর্শনার্থী হন তাহলে বিপদে পরার সম্ভবনা বেশি। আপনার স্ক্রীনে ভাসমান বা ব্রাউজারের সকল মেসেজ ক্লিক না করে আগে যাচাই-বাছাই করে নিন। এরপর অ্যাক্সেস করুন। আপনি সেটি মেন্যুায়ালি করতে পারেন অথবা হাতে সময় না থাকলে আপনাকে যত্ন নেওয়ার জন্য কেবল একটি অ্যাডওয়্যারের অপসারণ সরঞ্জামটি বা এ্যাপসটি ডাউনলোড করুন। আপনাকে হ্যাক করার চেষ্টা করা ব্যক্তি বা আপনার ডিভাইসে ফিশিং করছে সেগুলি আপনা থেকে রিমুভ করতে স্বক্ষম হবে।

৫) স্পাইওয়ার এবং ম্যালওয়্যার থেকে নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা রাখুন। হ্যাকিংয়ের সমস্যাগুলি কেবল ওয়েব-ভিত্তিক নয়। কোন ব্ল্যাক হ্যাকার কালো সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে আপনার ব্রাউজারটিকে হ্যাক করতে পারে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এগুলো আপনার অজান্তেই আপনার কম্পিউটারে ইনস্টল করতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি সফটওয়্যার আপনার ব্রাউজারে কিছু পপ-আপ বিজ্ঞাপনগুলি স্প্যাম করতে পারে। আপনি ম্যালওয়্যার, অ্যাডওয়্যার এবং স্পাইওয়্যার অপসারণকারীদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে ঝামেলাগুলো এড়াতে পারেন।

৬) শুধু ব্রাউজারের জাঙ্ক ফাইল অপসারণ নয়, আপনার ডেস্কটপে ইউন্ডোজ ফোল্ডারে গিয়ে টেম্প ফাইলগুলো ডিলিট এবং ফ্রন্ট স্ক্রীণে থাকা ডাস্টবিনটিও নিয়মিত পরিস্কার করুন।

৭। পাসওয়ার্ড সিলেকশনে যত্নবান হোন। আপনার পাসওয়ার্ডটি সবসময় শক্ত করুন। পাসওয়ার্ড সহজ হওয়া ভালো; তবে যেকোন শক্ত পাসওয়ার্ড আপনার অ্যাকাউন্টটি হ্যাকার থেকে নিরাপদ রাখবে। পাসওয়ার্ডটি কমপক্ষে ছয়টি অক্ষরের হওয়া উচিত, এর অধিক হলেও অসুবিধে নেই। অর্থাৎ বড় এবং ছোট অক্ষর, সংখ্যা এবং বিরামচিহ্ন বা সিম্বল, পাঙ্কচ্যুায়েশান মিশ্রণ থাকা উচিত।

৮। নিয়মিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন। অর্থাৎ প্রতি তিনমাস অন্তর আপনার ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডটি পরিবর্তন করুন। পাসওয়ার্ড চয়নের সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। উপরের সাত নম্বর পয়েন্টের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাসওয়ার্ডটি পরিবর্তন করে নিজের কাছে গোপনে সংরক্ষণ করুন।

এসব বিশেষ পদ্ধতিতে আপনার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টটি সেফ বা নিরাপদ রাখতে পারেন। অন্যথায় আপনার অ্যাকাউন্ট সবসময় ঝুকিপূর্ণ থেকেই যাবে। যেকোন সময় হ্যাকারের কবলে পরতে পারেন। যদি আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি ইতিমধ্যে হ্যাক হয়ে থাকে, তবে আতঙ্কিত হবেন না। এমন অনেকগুলি উপায় রয়েছে, আপনি হ্যাক হওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পুনরুদ্ধার করতে পারেন। তবে হ্যাকিং হওয়ার চেয়ে আগে থেকে উপায়গুলো খুঁজে সচেতন হয়ে, সাবধানে ডিভাইসে প্রয়োজনীয় এ্যাপ বা সফটওয়্যাগুলো ব্যবহার করে আপনার অ্যাকাউন্টটি নিরাপদ রাখাই উত্তম হবে।

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।