নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পেগামারী আমতলীতে স্থানীয় আদিবাসীদের সম্মতি না থাকলেও তাদের কৃষি জমিতে লেক খনন করার অভিযোগ করেছে আদিবাসী ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ। ১০ মার্চ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বন বিভাগের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন। সকাল ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘সাগর রুনি’ মিলনায়তনে বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’র সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ’র সঞ্চালনায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আদিবাসী যুব ফোরাম’র সাংগঠনিক সম্পাদক টনি চিরান।

সম্প্রতি বনবিভাগ বিশ্বব্যাংক এর সহযোগিতায় Sustainable Forest and Livelihood (SUFAL -সুফল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাছাড়া ‘মধুপুর জাতীয় উদ্যানের ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা’ বনবিভাগ আদিবাসীদের ভূমিতে সীমানা প্রাচীরসহ আরবোরেটাম বাগান, দ্বিতলবিশিষ্ট গেস্ট হাউজ, ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণসহ নানান স্থাপনা বাস্তবায়ন করছে। টাঙ্গাইল জেলাধীন মধুপুর উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত চুনিয়া, পেগামারি, পীরগাছা, সাইনামারী,ভূটিয়া, থানারবাইদ গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে ১১ নং শোলাকুড়ি ইউনিয়নের পীরগাছা মৌজার আমতলী নামক বাইদ (নিচু জমি)তে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের চিত্ত-বিনোদনের উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের তিন ফসলী আবাদি জমিতে বনবিভাগ কর্তৃক জোরপূর্বক কৃত্রিম লেক খনন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বন বিভাগের এহেন আত্মঘাতী পরিকল্পনার কারণে একদিকে যেমন বন ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে তেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ১২টি আদিবাসী কৃষক পরিবারের প্রায় ১২ একর আরওআর রেকর্ডভূক্ত স্বত্ব দখলীয় কৃষি জমি। যার ফলে আদিবাসীদের জীবন জীবিকার উপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে ও ব্যাহত হবে আদিবাসীদের কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতি। এছাড়াও প্রস্তাবিত লেক এর পাশে বসবাসকারী আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাবসহ মধুপুর বনের অবশিষ্ট প্রাকৃতিক বন ও পরিবেশের উপর স্থায়ীভাবে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন আদিবাসীরা।

টনি চিরান তার বক্তব্যে বলেন, “টাংগাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে ২৫ হাজারের অধিক গারো, কোচ ও বর্মণ আদিবাসী সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করে আসছে। তারা সেখানে পরম মমতায় বন ও জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করে আসছে। এ কারণে আদিবাসীরা এই প্রাকৃতিক বনভূমির ঐতিহাসিক সংরক্ষক ও ব্যবস্থাপক।”

আদিবাসীরা পুরো পৃথিবী জুড়ে বন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮০ শতাংশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “উপনিবেশ আমলে গড়ে উঠা বনবিভাগ বন রক্ষার নামে বিভিন্ন সময় বন ও পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে এই প্রাকৃতিক বনকে ধ্বংস করছে।”

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় বন বিভাগ উডলট বাগান বা সামাজিক বনায়ন কিংবা রাবার বাগানের নামে হাজার হাজার একর প্রাকৃতিক শালবন উজাড় করে পরিবেশ আগ্রাসী বিদেশি গাছ যেমন- রাবার, একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম গাছ রোপন করেছে। তাছাড়াও ইকোপার্ক, ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে বনের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা, জাতীয় উদ্যান, পিকনিক স্পট কিংবা ফায়ারিং ও বম্বিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করে দেশের অন্যতম পাতা ঝড়া প্রাকৃতিক বনের সর্বনাশ করেছে বলে অভিযোগ করেন টনি চিরান।

তিনি আরো বলেন, “উন্নয়নের নামে মধুপুর গড় থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের যে ষড়যন্ত্র চলছে তা উনিশ শতক থেকেই চলে আসছে। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমির মালিকানাকে অস্বীকার করে ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাক্ট’ ও ‘Acquisition and Tenancy Act (1950)’ এর মাধ্যমে মধুপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রায় ২০৮২৭.৩৭ একর আদিবাসী অধ্যুষিত বিশাল এলাকাকে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা ও তারের বেড়া দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বনবিভাগ গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে দাপুটে উচ্ছেদ নোটিশ প্রদান করা হয়। ২০০০ সালে বনবিভাগ ৩ হাজার একর ‘কোর এরিয়াতে’ ৬১ হাজার রানিং ফুট দেয়াল তুলে ইকোপার্ক প্রকল্প হাতে নেয় এবং ইকোপার্কের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সেই আন্দোলনে বনবিভাগ ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হন পিরেন স্নাল ও গুরতর আহত হয়ে চিরপঙ্গু অবস্থায় আজো বেঁচে আছেন উৎপল নকরেক।” অন্যদিকে আদিবাসীদের নামে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ বনরক্ষার নামে বিভিন্ন সময় বনবিভাগ ৭জন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

বনবিভাগের উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায়, ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বনবিভাগ ১৯২৭ সালের বন আইনের ২০ ধারায় চূড়ান্ত গেজেট জারি করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার ৯,১৪৫.০৭ একর ভূমি রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করেছে যেখানে ১৪টি আদিবাসী গ্রাম, বসতবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে টনি চিরান। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা না করেই সরকার জোরপূর্বক এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। মধুপুরের গারো-কোচ-বর্মন ও সাধারণ জনগণ এই সংরক্ষিত বন ঘোষণার বিরুদ্ধে জোড়ালো ভাবে প্রতিবাদসহ মহামান্য হাইকোর্টে আপিল করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কার্যত কোন উদ্যোগ গ্রহন করেনি বরং স্থানীয় আদিবাসী জনগণ উদ্বেগ, আতংক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছে।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ নিন্ম লিখিত দাবিসমূহ তুলে ধরে।

১। আদিবাসীদের কৃষি জমিতে প্রস্তাবিত লেক খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুত বাতিল করতে হবে।
২। আদিবাসীদের কাছ থেকে পূর্ব অনুমতি ও সন্মতি ছাড়া আদিবাসী এলাকায় তথাকথিত উন্নয়নের নামে কোন প্রকল্প গ্রহণ না করা ও ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধ করতে হবে।
৩। আদিবাসী অঞ্চলে আদিবাসীদের ক্ষতি হয় এমন সকল প্রকল্প যেমন- ইকোপার্ক, ইকো-ট্যুরিজম, জাতীয় উদ্যান, অবকাশযাপন কেন্দ্র, বানিজ্যিক কর্পোরেট পর্যটন বাতিল করতে হবে।
৪। কোনো বনভূমি এলাকা সংরক্ষিত, রক্ষিত, অশ্রেণীভুক্ত না অর্জিত তা চিহ্নিতকরণ বা ঘোষণার আগে আদিবাসী জনগণের সাথে অর্থপূর্ণ আলোচনা করতে হবে।
৫। আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিতকরণে গৃহীত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সনদ যা বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে তা দ্রত বাস্তবায়ন করা এবং আদিবাসীদের সম্মতিক্রমে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক বুশ নকরেক, গারো স্টুডেন্টস ফেডারেশন ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক লেবিয় ম্রং, বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়নের চন্দন কোচ, গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি সতীর্থ চিরান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শোভন রহমান, হাজং স্টুডেন্টস কাউন্সিল ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হরিদাস হাজংসহ বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।