নিজস্ব প্রতিবেদক, মধুপুর, টাঙ্গাইল: এ যেন কোনো ক্রাইম সিরিজকেও হার মানায়। প্রথমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে তারপর ব্ল্যাকমেইল করে বারংবার তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে মামুন নকরেক নামের এক গারো যুবক। ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গায়রা গ্রামে। ২৫ আগস্ট একটি মামলার ভিত্তিতে অভিযুক্ত মামুনকে গ্রেফতার করেছে মধুপুর থানা পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, “যুবতী ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা মামুন নকরেককে প্রাথমিকভাবে জবানবন্দি নিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করেছে।”
ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে চিপ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা হাসনাত মেয়ের জবানবন্দি নেন। জবানবন্দি নেওয়া পর মেয়েকে পুলিশ হেফাজতে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
ধর্ষক মামুন নকরেক, ছবি: সংগৃহীত
মেয়েটির ভাষ্যমতে, প্রথম ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের এক রাতে। মেয়েটি তখন ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। মেয়েটির এক মাসির বিয়েতে মালা গাথার জন্য ডাক দিয়ে নিয়ে যায়। মাঝপথে এক কলা বাগানে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে অভিযুক্ত মামুন। মামুন এতেই ক্ষান্ত হয়নি। ধর্ষণের ঘটনা কাউকে বললে মেয়েটিকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয় সে।
এর পরের বছর মেয়েটি একদিন দুপুর বেলা নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। তার মা-বাবা কাজের সূত্রে বাইরে ছিলেন। এর সুযোগ নিয়ে মামুন তার মোবাইলে মেয়েটির আপত্তিকর অবস্থার ছবি তোলে। সেই ছবিগুলো অস্ত্র বানিয়ে সে মেয়েটিকে অদৃশ্যভাবে জিম্মি করে ফেলে। এইভাবে সে মেয়েটির শারীরিক সম্পর্ক করে আর তা মোবাইলে ভিডিও করে। এইভাবে মামুন মেয়েটির সাথে একটি অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে যা তারা দুইজন ছাড়া আর কেউ জানতো না। মেয়েটি অভিযোগ করে বলেন, “মামুন নানা রকম হুমকি দিয়ে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে। আর বলতো এই ঘটনা কাউকে বললে ছবি, ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতো।” এই কারণে মেয়েটি কাউকে কিছু বলে নি। কিন্তু মামুনের স্ত্রী একদিন বিষয়টি জানতে পারে এবং তিনি মেয়েটিকে তাদের বাড়িতে ডাকে। ওদিকে মামুন ওই যুবতীকে হুঁশিয়ার করে দেয় যুবতীটি যেন কোনো কিছুই তার স্ত্রীর কাছে স্বীকার না করে। বললে রেকর্ডকৃত ভিডিও ফাঁস করাসহ হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
মেয়েটি এখন ৬ মাসের অন্তস্বত্তা। মেয়েটির দাবি এর আগেও সে অন্তস্বত্তা হয়েছিলো। সেটা গত বছরের এপ্রিলে সে এ্যাবর্সন করে ফেলে।
ব্ল্যাক মেইলের শিকার যুবতীর মায়ের ভাষ্য, তারা কিছুই জানতো না। এক মাস আগে ঢাকা থেকে একজন বিষয়টি তাদেরকে অবগত করে। জানার পরে তারা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিন্তু মেয়েটি স্বীকার করে নি। মামুনকে জিজ্ঞাসা করা হলে সেও জোড়ের সাথে অস্বীকার করে বলে জানান মেয়েটির মা। পরে মেয়ের শরীরের গড়ন দেখে সন্দেহ হলে ক্লিনিক্যাল চেকআপ করানো হয়। এতে গর্ভাবস্থা ধরা পড়ে। মেয়ের মা এবং গায়রার ‘সালমিখাং যুব সংগঠন’র নেতৃবৃন্দের দাবি বিষয়টির সমাধানের জন্য সামাজিকভাবে বৈঠকে বসলেও কোনো সুরাহা দিতে পারেননি স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তাদের অভিযোগ, উল্টো মাতব্বররা অভিযুক্তের পক্ষ নেওয়ার চেষ্টা করে।
পরবর্তীতে মেয়েটির পরিবার আর কোনো উপায়ন্তর না দেখে যুবতীটির মা গত ২৪ আগস্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। এই মামলার ভিত্তিতে ২৫ আগস্ট বিকালে মামুন নকরেককে উপজেলার গায়রা গ্রামে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামুন বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
অন্যদিকে মামুনের স্ত্রী দীপ্তি আসাক্রা ধর্ষণের বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে আ.বিমা টাইমসকে বলেন, “আমার স্বামী মেয়েটিকে কখনোই ধর্ষণ করে নি। মেয়েটিই আমার স্বামীকে ভুলিয়ে সম্পর্ক করেছে।” তার স্বামীর সাথে মেয়েটির পাঁচ বছরের সম্পর্কের বিষয়টিকেও মিথ্যা দাবি করেন। তার মতে তাদের মধ্যে দুই বছরের সম্পর্ক। তার দাবি অনুসারে মেয়েটিই তার স্বামীকে বিভিন্ন সময় ফোনে নানা রকম ম্যাসেজ দিতো। সেই ম্যাসেজ দেখে তার সন্দেহ হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে সে মেয়েটিকে তাদের বাড়িতে ডেকে তার স্বামীকেসহ মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে; কিন্তু দুইজনের কেউই সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করে নি। পরে তার জোরাজুরিতে মামুন সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বলে জানান মামুনের স্ত্রী দীপ্তি। ঐ যুবতীই নাকি মামুনকে ভুলিয়ে সম্পর্ক করতে বাধ্য করে। মামুনের স্ত্রী দীপ্তি বলেন, “মেয়েটি আমার সংসার ভেঙেছে। মেয়েটি নানাভাবে আমার স্বামীকে দেখা করতে বাধ্য করতো। কখনো হাত কেটে রক্ত বের করে আমার স্বামীকে ভিডিও কল করতো।” মেয়েটির পড়াশোনার জন্য যাবতীয় কাগজ-পত্র উঠানো, জমা দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ তার স্বামীকে দিয়ে করাতো এবং এগুলো মেয়ের মা-বাবা জানতেন বলে দাবি করেন দীপ্তি আসাক্রা।
এ ব্যাপারে জানতে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’র সভাপতি তথা গায়রা গ্রামের বাসিন্দা ইউজিন নকরেককে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম সামাজিকভাবে সমাধান করার জন্য। মেয়ের পরিবার মানেনি। পরে আমরা বলে দিয়েছি ঠিক আছে তাইলে আইনের আশ্রয় নেও।” এদিকে ধর্ষকের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগটি তিনি অস্বীকার করেন।