গেল ২৫ জুলাই প্রয়াত ফা. ইউজিন হোমরিকের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী ছিল। দ্যা আ.বিমা টাইমস২৪ নিউজ ডট কম অনলাইন বিশেষ নিউজও কভার করেছে। মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপের আমি সদস্য নই; তথাপিও তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপে মধুপুরে ফাদার হোমরিকের নামে সড়ক নামকরণের দাবিটি সঙ্গত কারণে যৌক্তিক বলে মনে করি। যদ্দুর জানি বিদেশ বিভূঁই হারুণ রসিদ মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপের সম্মানীত শুধু সদস্যই নন, এডমিন প্যানেলের অন্যতম সঞ্চালক, এবং পরামর্শ দাতা তিনি। এই গ্রুপের প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ আমাকেও মাঝেমধ্যে-ই মুগ্ধ করে বৈকি !

প্রবাসী রসিদ মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপের পক্ষ থেকে ফাদার হোমরিকের ১ম মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এবং অকুন্ঠভাবে লিখেছেন যে, ‘প্রচার বিমুখ এই মহান মানুষটির সম্পর্কে মধুপুরের বর্তমান প্রজন্ম তেমন কিছুই জানেন না। যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু মধুপুর গড়ের শালবনের সঙ্গে গভীর মিতালি করে কাটিয়ে দিয়েছেন ৬ যুগ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা বিরোধিতা করলেও তিনি আমেরিকান নাগরিক হয়েও মুক্তি পাগল জনতাকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়েছেন, ধরেছেন অস্ত্র। শুধু তাই না আজকের আধুনিক সুশিক্ষিত গারো জাতি গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অবদান অসাধারণ।‘

তিনি আরও সেখানে লেখেন, ‘যুদ্ধকালীন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরস্ত্র বাঙালিদের তিনি সহায়তা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্য যাঁরা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন, সেই বিদেশি বন্ধুদের বাংলাদেশ সরকার বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেছেন। এই নিঃস্বার্থ বিদেশি বন্ধুটি ২০১২ সালে সেই সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন।‘

পশ্চাৎপদ জনপদ মধুপুর অঞ্চলে ফাদার হোমরিক এক আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছিলেন। তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পাশাপাশি নিরলসভাবে মানবকল্যাণে কাজ করে গেছেন দীৰ্ঘ ৬ দশক। এই ছয় দশকে শিক্ষা বিস্তারে অতুলনীয় অবদান, মুক্তিযুদ্ধের সময় অসামান্য অবদানের জন্য মধুপুরের মানুষের মনের খুব গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকার নাগরিক হয়েও যিনি মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। ফাদার ইউজিন হোমরিক গত ১৩ আগস্ট ২০১৬সালে নীরবেই মধুপুর তথা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্রে। অবসরে সেখানেই তিনি বসবাস করছিলেন। মরণব্যাধি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ফাদার ইউজিন হোমরিক ১৯৫৫ সালে হলিক্রস মিশনারি হিসেবে বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন। মধুপুর শালবন তখন গহীন অরণ্য, বাঘ, ভালুক, হরিণ, হাতি ও বন্যপ্রানীতে ভরপুর। দুর্ভেদ্য এ বনে তখন ধর্ম প্রচার করতে আসেন তিনি। সে সময় এলাকার গারোরা ছিল বেশির ভাগই সাংসারেক ধর্মে অনুসারী। ফাদার ইউজিন হোমরিক এখানে হিংস্র বন্য প্রাণীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন বাজি রেখে গড় এলাকার জলছত্র নামক স্থানে আস্তানা গড়েন। হাওদা বিলের স্বচ্ছ জল আর শাল গজারির মৌ মৌ গন্ধে কাটতে থাকে দিন। প্রকৃতি প্রেমি এ মানুষটি ধীরে ধীরে জলছত্র গ্রামের আশপাশে ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি উপভোগ করতেন। মধুপুরের সকল গারো অঞ্চলে চষে বেড়াতেন। তখন জনসংখ্যা ছিল একেবারে কম। প্রতিবেশী গারোদের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্যতা। টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ সড়কের পঁচিশ মাইল নামক স্থানে স্থানীয় গারোদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের বীজ বুনতে শুরু করেন। মিশনে গারো আদিবাসীদের যাতায়াত বাড়তে থাকে। সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ফাদার হোমরিক। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর ধর্ম প্রচারের কাজ। মানবতার সেবায় তিনি এগিয়ে যেতেন দ্রুত গতিতে। তিনি বাহ্যিকভাবে মৃত্যু হলেও ফা. হোমরিকের কর্মযজ্ঞ মধুপুরের মাটিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে, দিয়ে যাচ্ছে অগণিত মানুষের সেবা।

জনাব রসিদের লেখনীর শেষ বাক্যগুলো আমার মনে দারুন দাগ কাটে। তিনি সেখানে অবলীলায় বলেছেন, ‘তাঁর জীবদ্দশায় আমরা পারতাম মধুপুরে একটা সংবর্ধনা দিতে, পারতাম তাঁর নামে একটি রাস্তার নাম করতে, পারতাম নাগরিকত্ব দিতে। কিছুই দিতে পারি নি কিন্তু উনি উনার জীবনের সবটুকু সময় মধুপুরকে দিয়ে গেছেন। মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপের পক্ষ থেকে উনার নাম ২৫ মাইল থেকে দোখলা পর্যন্ত রাস্তাটিকে ফাদার হোমরিক রোড নাম করণের জোড় দাবি জানাচ্ছি।’

প্রয়াত ফা. হোমরিককে নিয়ে দুটি বাক্য লেখার কোন যোগ্যতা আমার নেই। তাঁর বিভিন্ন অবদান, শিক্ষার আলো মধুপুর গড়াঞ্চলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে; তা নিজ বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করার উপায় নেই। মধুপুর গড়ে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকা শাল গাছ, বৃক্ষলতাই এর স্বাক্ষী।

মধুপুরবাসী ফেইসবুক গ্রুপের এই দাবিকে সাধুবাদ জানাই; তবে এ দাবি আগে কেন আসে নি গারো আদিবাসী থেকে এই ভেবে আমার ব্যক্তিগতভাবে দু :খবোধয় হয়! আধুনিক সুশিক্ষিত গারো জাতি গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমকে সম্মান, বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জানানো উচিত। তাঁর অবদান, অসাধারণ এই মহানুভবতা ও আর্দশকে ধরে রাখতে টাঙ্গাইল জন প্রশাসনের সুদৃষ্টিসহ এটিকে কার্যকর করার জোড় দাবি জানাই।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী, lchiran76@gmail.com