আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে মাশরুম একটি অতি প্রাচীন এবং সুপরিচিত খাবার হলেও পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে একেবারেই নতুন। এটি খাদ্য তালিকায় এবং স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হয়েছে। মাশরুম ক্লোরোফিল (Chlorophyll) বিহীন ছত্রাক জাতীয় উদ্ভিদ; যা আগারিকাস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। অনুমান করা হয় যে পৃথিবীতে প্রায় ১,৪০,০০০ ধরণের মাশরুম রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য এবং ঔষধিগুণ সুবিধার জন্য মাত্র ১০০টি বিজোড় মাশরুমকে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। মাশরুম একটি ছত্রাক জাতীয় সবজি যা সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও উচ্চ খাদ্যশক্তি এবং ভেষজগুণে ভরপুর। মাশরুমে ২৫-৩০% প্রোটিন আছে যা অত্যন্ত উন্নত ও নির্ভেজাল। এতে উপকারী শর্করা, চর্বি আছে; যে কারণে মাশরুম বিভিন্ন জটিল রোগের প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। মাশরুমের পুষ্টিগুণগুলো ভেষজ হিসেবে কাজ করে যেমন কোলেস্টেরলগুলি কেটে ফেলা, ক্যান্সার প্রতিরোধ, প্রতিরোধ ব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধি, ওজন হ্রাসে সহায়তা করা, এছাড়াও মাশরুমের অসংখ্য স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে। মাশরুমে পুষ্টিগুণের পাশাপাশি যেসব ঔষধিগুণ পাওয়া যায় সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

মাশরুমের কিছু ঔষধিগুণ যা শরীরে কিছু প্রধান দুরোগ্যব্যাধির ভেষজ হিসেবে কাজ করে, যেমন-

১) শরীরে কোলেস্টেরল কমায়। মাশরুমে কোনো ফ্যাট বা কোলেস্টেরল থাকে না। এটি চর্বিযুক্ত প্রোটিন, ফাইবার এবং কিছু খুব গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম সমৃদ্ধ খাবার। মাশরুমে পাওয়া চর্বিযুক্ত প্রোটিন এলডিএল কোলেস্টেরল নির্মূল করতে সহায়তা করে। অতিরিক্ত রক্তচাপ, এলডিএল এবং এইচডিএল কোলেস্টেরলের একটি ভাল ভারসাম্য তৈরি করে যাতে শরীর স্ট্রোক, এথেরোস্ক্লেরোসিস ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে।

২) ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকরী। যেমন মহিলাদের স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারকে ব্লক করতে মাশরুম দুর্দান্ত কার্যকর। মাশরুমে উচ্চ লিনোলিক অ্যাসিড এবং বিটা-গ্লুকানগুলি থাকার কারণে খুব ভাল অ্যান্টি-কার্সিনোজেন হিসাবে কাজ করে। লিনোলিক অ্যাসিড, অতিরিক্ত এস্ট্রোজেনকে সাফল্যের সাথে দমন করতে পারে যা মহিলাদের স্তন ক্যান্সার রোধে কাজ করে। এছাড়াও বিটা গ্লুকান প্রস্টেট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের কোষগুলির বৃদ্ধি দমন করতে পারে।

৩) ডায়াবেটিস বা বহুমুত্র রোধে এবং ডায়াবেটিস রোগীর জন্য মাশরুম একটি আদর্শ খাদ্য। এগুলিতে কোলেস্টেরল থাকে না, কম ফ্যাট থাকে, উচ্চ প্রোটিন থাকে এবং প্রচুর খনিজ ও ভিটামিন থাকে। এগুলি ছাড়াও মাশরুমগুলিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং জল রয়েছে। তবে সবচেয়ে জটিল উপাদানটি হল মাশরুমের মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক ইনসুলিন। খাদ্য আইটেমগুলিতে পাওয়া স্টার্চ ভেঙে ফেলতে সহায়তা করে। মাশরুমের কয়েকটি উপাদান রয়েছে যা লিভার, এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি ইত্যাদির যথাযথ কার্যক্রমে সহায়তা করে এটি দেহের মধ্যে ইনসুলিনের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

৪) হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় মাশরুম ক্যালসিয়ামের খুব ভাল উৎস। মাশরুম নিশ্চিত করে মানুষের শরীরে বিভিন্ন হাড়ের পর্যাপ্ত শক্তি বজায় রাখতে। মাশরুম নিয়মিত খেলে অস্টিওপোরোসিস, জয়েন্টে ব্যথা এবং অস্থিরতার মতোন অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে।

৫) শরীরে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে। মাশরুমের বিভিন্ন ধরণের যেমন মাইটেক এবং শিটকে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে। যার ফলে শরীরের রক্তচাপ হ্রাস করে রক্তনালীগুলিকে সাফল্যের সাথে শিথিল করতে পারে। পটাসিয়াম সামগ্রী বর্ধমান জ্ঞান ধরে রাখতে এবং একটি উন্নত স্মৃতিতে সহায়তা করে।

৬) মাশরুমে সেলেনিয়াম সামগ্রী রয়েছে। নিরামিষাভোজীদের সেলেনিয়াম গ্রহণের অন্যতম প্রধান উপায় হল সেলেনিয়াম উপাদান। সেলেনিয়াম হাড়, দাঁত এবং চুলকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। সেলেনিয়ামকে খুব শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।

৭) মাশরুমে এইডস প্রতিরোধে একটি গুণ রয়েছে যারা নাম ট্রাইটারপিন (Triterpin)। এ শক্তিশালী পুষ্টিগুণ থাকাতে বর্তমানে এটি বিশ্বে এইডস প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৮) কিডনির রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। মাশরুমে নিউক্লিক এসিড (Nucleic Acid) ও এন্টি-এলার্জেন (Anti-Allergen) থাকায় এবং সোডিয়ামের (Sodium) পরিমাণ কম থাকায় কিডনি রোগ ও এলার্জি রোগের প্রতিরোধক।

৯) হেপাটাইটিস-বি ও জন্ডিস প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিড (Folic Acid), লৌহ এবং লিংকজাই-৮ (Linkzai-8) নামক এমাইনো এসিড থাকায় হেপাটাইটিস-বি ও জন্ডিসের প্রতিরোধক।

এছাড়াও মাশরুম খেলে আরও যে সমস্ত সাধারণ রোগের প্রতিরোধক এবং ভেষজ ঔষধি হতে পারে, যেমন-

  • গর্ভবতী মা ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধে। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন ও মিনারেলের এমন সমন্বয় আছে যা শরীরের ইমিউন সিষ্টেমকে (Immune System) উন্নত করে। নিয়োসিন ও অ্যাসকরবিক এসিড (Niacin and Ascorbic Acid) বা ভিটামিন সি’র প্রাচুর্য থাকায় মাশরুম স্কার্ভি (Scurvy), পেলেগ্রা (Pellegra) প্রভৃতি শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত উপকারী খাবার।
  • আমাশা রোগ নিরাময়ে মাশরুম কার্যকর। মাশরুমে ইলুডিন এম ও এস (Eludin M & S) থাকাতে আমাশা ভালো হয় ।
  • হাইপার টেনশন প্রতিরোধে মাশরুম। এটিতে মূলত স্ফিংগলিপিড (Sphingolipid) এবং ভিটামিন-১২ বেশি থাকায় স্নায়ুতন্ত্র ও স্পাইনাল কর্ড (Spinal Cord) সুস্থ্য রাখে। ফলে মাশরুম খেলে হাইপার টেনশন (hypertension) দূর হয় এবং মেরুদন্ড দৃঢ় থাকে।
  • পেটের পীড়ায় বা সহজপাচ্য প্রোটিন যোগান দেয়। মাশরুমে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন আছে। এই প্রোটিন সহজপাচ্য, সুস্বাদু ও মুখরোচক। মাশরুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ এনজাইম (Enzyme) বিশেষত যেমন ট্রিপসিন (Trypsin) এবং অগ্ন্যাশয় থেকে নির্গত জারকরস (Jerkros) আছে বলে মাশরুম খাদ্য পরিপাক ও হজমে সাহায্য করে, রুচি বর্ধক এবং পেটের পীড়া নিরামায়ক হিসেবে কাজ করে।
  • মাশরুম এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতারোধ কল্পে অত্যন্ত কার্যকর। শরীরে এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে নিয়মিত মাশরুম খেলে তা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
  • মাশরুমে খনিজ লবন থাকে যা দৃষ্টিশক্তি রক্ষার জন্যে সমাদৃত।

মাশরুম খেলে যেমন মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতা বাড়ায়, প্রচুর পুষ্টিকর গুণ রয়েছে তেমনি এর অপকারিতা, কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। নিয়মিত মাশরুম খেতে হলে এবং আপনার শরীরে কঠিন রোগব্যাধি থাকলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী খাওয়া বা বিরত থাকা উত্তম হবে।