সম্প্রতি প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড ২০২১ সালের সেরা অদম্য সাংবাদিক হিসেবে ভূষিত হলেন। মূলত স্বাধীন সাংবাদিকতায় এ পুরস্কারে ভূষিত করেন তাঁরা। ফলে তাঁকে শুধু প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালেই যথেষ্ট নয়, স্বাধীন সাংবাদিকতা একটি গণতান্ত্রিক দেশ, রাষ্ট্রের জন্যে জরুরি তারই বার্তা দেয় । তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্যে লড়াই করেছেন, ভবিষ্যতেও লড়াই করবেন এমনটায় আমরা প্রত্যাশা করি। তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাছে জিম্মি হবেন না, পেশাগত দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতায় অবিচল থাকবেন।

স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা কোথাও কী নেই ! এই স্বাধীন সাংবাদিকতা, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা নিগ্রহের শিকার হন। গত ১৭ মে অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন। তাঁকে সেখানে প্রায় ছয় ঘণ্টা তেজগাঁও থানার গারদে আটক রেখে পরে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা দায়ের করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজ তুমুল আন্দোলনে এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার ও সাংবাদিক সংগঠনও। এরপর তাঁকে পাঁচ দিন পর আদালত রোজিনাকে জামিন মঞ্জুর করে।

রোজিনা ইসলাম আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হলেও নেদারল্যান্ডে গিয়ে নিজ হাতে ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ডটি নিতে পারেননি। আনন্দঘন মূহুর্তে ভারাক্রান্ত মনে তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত তাঁর পাসপোর্ট, মুঠোফোন ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সচিবালয়ে প্রবেশের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও ফেরত দেওয়া হয়নি। যা সত্যিই ব্যতিত করে সকল সাংবাদিক মহলকে এবং দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে বারংবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের।

একটি দেশে যখন দুর্বল গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং ন্যায়বিচার পাওয়া প্রায় দুরূহ, আর তখনি একটি রাষ্ট্রযন্ত্র সংবাদ মাধ্যম, সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ ভাবেন। ঠিক সেসব দেশেই সাংবাদিকদের আরও বেশি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে কাজ করে যেতে হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে পৃথিবীব্যাপী সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। দেশের এমন দুর্বল কাঠামোতে রাজনীতির ছত্রছাড়ায় দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন বাড়ছে দেশে।

যদি বিখ্যাত ব্যক্তিদের উক্তি দেখি, সাহসিকতার বিপরীত কাপুরুষোচিত নয়, সঙ্গতিপূর্ণ- রবার্ট, এছাড়াও  ইই কামিংস বলেছেন,  বড় হওয়ার এবং আপনি সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে সাহস লাগে। জেনে রাখা ভালো- সাহস, দু :সাহস দুটোই সাংবাদিকতায় প্রয়োজন। সর্বপরী সত্যিকার, এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় আরও বেশি প্রয়োজন।

আপনারা জানেন, স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য লড়াই করা সাংবাদিকদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড বলেছে, ‘বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন রোজিনা ইসলাম। তিনি করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম প্রকাশ্যে এনেছেন। এখন নিজের দেশে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেতে হচ্ছে হয়রানির মধ্য দিয়ে। সাংবাদিকতায় রোজিনা ইসলামের সাহসিকতা ও নিরলস প্রয়াসের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।’

আন্তর্জাতিকভাবে রোজিনা ইসলামের এ অর্জন ও সম্মান প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সাহসী সাংবাদিকতারই বিজয়। তিনি সাহসী সাংবাদিকতার প্রতীকী। তাঁর এ পুরস্কারপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে দেশের সাংবাদিক মহলকে সাহস জোগাবে, সামনের দিনগুলোতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় মনোবল, শক্তি সাহস বাড়াবে। পাশাপাশি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকে সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ না ভেবে, বন্ধু ভাবতে শিক্ষা দেয়। তাই সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা না দিয়ে, বরং দেশের উন্নয়ন এবং দুর্বল কাঠামোকে খোঁজে বের করতে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করে দেশকে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন। রোজিনার মতোন সাংবাদিকদের না ধরে বরং দুর্নীতিবাজদের ধরুন, আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করুন। এতে দেশে সাহসী সাংবাদিকতায় সাহস জোগাবে, তেমনি সৎ সাংবাদিকতার প্রতিও সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা বাড়বে, আপন গতি আর উন্নতিতে দেশ এগিয়ে যাবে।