শিশিলিয়া কুবি। তার গল্প শুনলে মনে হবে তিনি একটু বেশি কথা বলেন! বয়সের ভারে একেবারে নুজ্য। ভাষ্য মতে, বয়স তার ১৩৫ ছুঁই ছুঁই হবে। তিনি মোট ১২জন সন্তানের জননী। এর মধ্যে ৬ ভাই ও ৬ বোন। মেয়েরা বয়সের ভারে চারজনই মারা গেছেন। এখন বেচে আছেন দুইবোন ও ছয়ভাই। নাতিনাতনি ও নাতিনাতনিদের ঘরে কজন সন্তান জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার নাতিপুতি আর সুতির সংখ্যা এখন প্রায় ৭০-৮০ জন। তার এক মেয়ের সাথে তিনি থাকেন। শিশিলিয়ার মেয়েও বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু তার মা (শিশিলিয়া কুবি) বা খ’সে বুড়ি এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য আছেন। এখনো লাঠি ভর করে ঘুরে বেড়ান পুরো গ্রাম।

বলছিলাম শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানার শিশিলিয়া কুবি ওরফে খ’সে বুড়ির কথা। গারো লোকগান সেরেজিং নিয়ে গারোহাব মিডিয়া পরিবারের হয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করার উদ্দেশ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই গ্রামে। শিশিলিয়া কুবির স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। কত সালে মারা গেছেন তাও তার মনে নেই। মজার ছলে জানতে চাইলাম, আম্বি আপনাকে খ’সে বুড়ি ডাকা হয় কেন? একটু জোড়ে হেসে বললেন, সে আরেক কাহিনী। তোমার আচ্ছু কামলা দিয়ে চাষাবাদ করতেন। কামলারা তারাতারি করতে গিয়ে পাতলা করে ধান লাগাতেন দেখে রেগে যেতেন তিনি। তখন রাগ করে সব সময় বলতেন খ’সে দেহি (তার মানে- বলুন তো দেখি) অর্থাৎ এইভাবে ধান লাগালে কি চলবে? তার প্রতিটি কথায় এই খ’সে শব্দটি বহুবার শুনা যেত বা বলতে শুনা যেতো। এভাবে এক কথায় বহুবার খ’সে শব্দটি বলার কারণে বুড়ার নাম (স্বামী) হয়ে যায় খ’সে বুড়া আর বুড়ির (স্ত্রীর) নাম হয়ে যায় খ’সে বুড়ি। খ’সে শব্দটির মানে হলো ‘খ’ অর্থাৎ গ্রাম্য ভাষায় ‘ক’ মানে হলো ‘বল’ যেমন কথা ক, কথা কও ইত্যাদি। অর্থটি উচ্চারণগত ভাবে শুদ্ধ করে বললে এটি হবে ‘ক’সে’ । মানেটা হলো একটি প্রশ্নবোধক আস্ফালন। মুদ্রাদোষ বা ব্যক্তিগত বদভ্যাস কারণে শিশিলিয়া কুবির স্বামীর ব্যবহৃত এই শব্দটি তাদের দু’জনের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়; অর্থাৎ তাদেরকে খ’সে বুড়ি বা বুড়া বলে গ্রামের সবাই চিনতো।

শিশিলিয়া কুবির আদি নিবাস মধুপুর গড়াঞ্চলে। অনেক ছোটবেলায় মধুপুর বা আ.বিমা থেকে তার বাবা মা তাদের নিয়ে চলে আসেন শেরপুর জেলার বাকাকুরা গ্রামে। আবার সেখান থেকে চলে আসেন বড় গজনী গ্রামে। শেষ ঠিকানা বাধেন ছোট গজনীতে। আনুমানিক কত সালে চলে আসেন জিজ্ঞেস করলেও তিনি সালটা বলতে পারেন না। তিনি বলেন যে, সেটা ছিল বৃটিশ আমল। মধুপুরের কোন গ্রামে ছিলেন জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আমরা যেখানে ছিলাম সেটাকে আগে বলা হতো ‘মাইঠ্যা আসং’ সেখান থেকেই তারা এখানে বসবাস গড়েছেন। আদি ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংসারেক। তবে সে ব্যাপারে তিনি তেমন কিছু আর মনে করতে পারছেন না। সাংসারেক ধর্ম পরিত্যাগ করে বা  ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি একজন ব্যাপটিস্ট খ্রীস্টান বিশ্বাসী ছিলেন। এরপর এখন তিনি রোমান ক্যাথলিক হয়েছেন। এসব তথ্যানুযায়ী ধরা যায় আঠারো শতাব্দীর শেষের দিকে ও ১৯ শতাব্দীর শুরুর দিকে গারো এলাকায়  ব্যাপটিস্ট চার্চ এর যে প্রভাব পরেছিল তিনি সেই সময়েরই একজন আদি ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান ছিলেন।

ছোট গজনী গ্রামের ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই গ্রামে আমরা যখন বসবাস করতে শুরু করেছি তখন মাত্র ৫-৬ টি গারো বাড়ি ছিল। আর পুরো গ্রামবাসীই আমার মধ্য দিয়ে খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। তিনি আরও জানান ৬৪ সালের রায়তের কথাগুলো। শুধু তার স্পষ্ট মনে আছে তিনি যখন ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন রাতের আঁধারে কোলে ছোট বাচ্চা নিয়ে তাকে বর্ডার পার হতে হয়েছে। আবছা আবছা যতটুকু মনে আছে সেদিনের ইতিহাসগুলো বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্ত তেমন কিছুই মনে আসছিল না। মূলত: বয়সের ভারের কারণে তার বলা কথাগুলো তেমন কিছুই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না। তার প্রয়াত স্বামীর নাম রাতজিং দফো। জানতে চাইলাম প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন কিনা? একটু ক্ষেপে গেলেন খ’সে আম্বি। একটু ইতস্তত বোধ করে বললেন, আমাদের যুগে কোন প্রেম টেম ছিল না। গারো প্রথায় জোড় করে ধরে নিয়ে বিয়ে দেওয়া হতো মামা মামির ছেলে মেয়েদের সঙ্গে। তবে শিশিলিয়ার বিয়ে গারোদের প্রাচীন প্রথাগত রীতি বা সাংসারেক নিয়মে বিয়ে হয়নি। বিয়ে করেছিলেন খ্রীস্টান হয়ে। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী থানার মাঝামাঝি গ্রাম বাওয়ইবাধা নামক গ্রামে ছিল একটি ব্যাপটিস্ট চার্চ এবং সেখানেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কথা বলতেই বলে ফেললেন স্বামী দেখতে সুঠাম এবং সুন্দর ছিলেন। তিনিও তার মতোই দেহের রঙ কালো ছিলেন। স্বামীর পছন্দের খাবার ছিল মি.আ ফুরা। মি.আ ফুরা মূলত বাঁশের অঙ্কুরোদগম হওয়ার পর নরম অবস্থায় থাকলে সেটিকে কেটে এনে এক ধরণের চালের গুড়া দিয়ে তেল বিহীন বিশেষ পদ্ধতিতে গারোদের ঐতিহ্যবাহী একটি রান্না। রাতজিন দফো বা শিশিলিয়া কুবির স্বামী এই খাবার পেলেই খুব খুশী হতেন। স্বামীর অতীত গল্প শুনাতে গিয়ে তিনি একসময় আবেগপ্রবন হয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকেন পুরনো দিনের কথা ভেবে।

কোন মতে চলাফেলার শক্তি সামর্থ্য থাকলেও শিশিলিয়া নিজে আর তেমন ভালো মন্দ আর খেতে পারেন না। এখন অল্প খেলেই পেট ব্যাথ্যা হয়ে যায়। বয়সের ভারে অনেক কিছুই তিনি মেনে নিয়েছেন। তিনি বাঁচতে চান আরও অনেক দিন। দেখতে চান এলাকার উন্নয়ন। নতুন প্রজন্মের পরিবর্তন। কালের স্বাক্ষী এই আম্বি শিশিলিয়ার বুকে হাজারও কথা জমা, এখানো হাজারো স্বপ্ন আঁকে আগামীদের কথা ভেবে। অতীতের অনেক কথা তার মনে নেই। যাও কিছু মনে আছে তার; কিন্তু তাও শোনার কেউ নেই। এভাবেই তিনি নীরবে নিভৃতিতে দিনাতিপাত করছেন। প্রতিদিন হাটেন গ্রামের রাস্তায়। বেড়াতে যান আত্নীয় সজনের বাসায়।

আপনাদের কাছে শিশিলিয়ার গল্প শোনানোর হেতু এই, এমন অনেক শিশিলিয়া আমাদের প্রত্যেকের গ্রামে খুঁজলে পাওয়া যাবে। এরা হয়তো বেশিদিন আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। কিন্তু থেকে যাবেন ছোট গজনী গ্রামের শিকড় হয়ে কারোর মনের মণিকোঠায়।

ছোট গজনী গ্রামের কথা, হারিয়ে যাওয়া সেরেজিং এর কথা, আর বেচে থাকার অল্প কিছু সেরেজিং এর সুরের মুর্ছনায় ডুবে যেতে হলে অপেক্ষা করুন গারোহাবের ইউটিউব চ্যানেলে (GaroHub Youtub Channel। আমরা আসছি আপনাদের জন্য নতুন গল্প নিয়ে।

খ’সে আম্বির গল্প শুধুমাত্র একটি গল্প নয়; এটি আমাদের আদি অস্তিত্বের দলিল। শিশিলিয়া বা খ’সে আম্বির দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: বাপন নেংমিঞ্জ, শেরপুর