গারো আদিবাসীরা প্রাকৃতিকভাবে বৈশিষ্টগত শান্ত সুবোধ এবং বাধ্য সন্তান বলে আপাদমস্তক এক অগাধ বিশ্বাসের জাল বুনেছিল। হ্যাঁ কথাটি স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীতেও শতভাগ সত্য ছিল। যার দরুন অনেককে মাথা উঁচু করে নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে সিনা টান করে বহুবার বলতে শুনেছি, দেখেছি লেখনী কাগুজে, অথবা সোস্যাল মিডিয়াতে যে আমাদের গারো সমাজে ‘খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং’ শব্দ বলে গারো অভিধানে নেই। কিন্ত কালের বির্বতনে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং বলে কোন শব্দ গারো অভিধানে নেই কথাটি মিথ্যে হতে চলেছে কী! এ অচেনা শব্দগুলো চেনা আদিবাসীদের অভিধানে নতুন করে যুক্ত করলো। এটি আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও এটিই বাস্তবের বাস্তব সত্য কথা। এতোদিন তো শুনেছি বিজাতি কেউ গারো নারীকে দুর্বল, একা পেয়ে ধর্ষণ করেছে; আর এবার স্বজাতি গারো ভাই ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ফিল্মি কায়দায় ধর্ষণ করেছে! কথাটি শুনতে কেমন জানি খটকা লাগে!

গারো আদিবাসী সহ অন্যান্য আদিবাসীদের সামাজিক শিষ্টাচার, সমাজ ব্যবস্থা, শৃঙ্খলাবোধ এবং প্রথা ইত্যাদি অলিখিত হলেও সেগুলো দেশের আইনের মতোন মানতো এটা হলফ করে বলতে পারি। কিন্ত যুগের বিবর্তনে, নানা বৈরি পারিপার্শ্বিকতায় গারোদের জীবন শৈলীতেও বিশেষ কিছু পরিবর্তন এসেছে এ সময়ের পত্র পত্রিকা খুললে বহু নজির পাওয়া যাবে।

গারো সমাজের অপরাধ বিশ্লেষণ করলে যা দেখি, প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি মানুষই তাদের ঐতিহ্যগত কতকগুলি রীতিনীতি ও সামাজিক বিধিবদ্ধ দ্বারা আবদ্ধ। গারোরাও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ তুলনামূলকভাবে সংখ্যাগুরুর চেয়ে একটু বেশি সহজ সরল; আবার অনেক জাতি জাতিগতভাবেই সহজ সরল হয়ে থাকে। আবার অনেকে মনে করেন, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাপে বা ভয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডথেকে সংখ্যালঘুরা দূরে থাকে এবং নিজেদের মধ্যে শক্তি, সাহস, ঐক্যতা বজায় রাখতে সরল জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। তবে, পরিবেশে চলতে গিয়ে- বিশেষভাবে কারোর প্রলোভনে পড়লে, অথবা বারবার নির্যাতন, অন্যায় অত্যাচারের সম্মুখীন হলে বাধ্য হয়ে এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে সংখ্যালঘুরাও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। অর্থাৎ কমবেশি সকল সমাজেই অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু গারো সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- গারোদের সমাজে লিখিত কোন আইন নেই; কিন্তু তাদের সমাজে চমৎকার সামাজিক বিধিবিধান, আচার ও বিচার ব্যবস্থা থাকায় এবং এই সামাজিক বিধিবিধান, আচার ও বিচার ব্যবস্থা সকলেই নির্দ্বিধায় লালন-পালন করার কারণে গারোদেরকে সহজে রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় নিতে তেমন দেখা যায় না। গারো সমাজে সংনকমা (গ্রামমাতব্বর), খামাল (পুরোহিত), চ্রা-মানক (মা-মাসি-বোনেরা, মামা-ভাইয়েরা), জিকচল (স্ত্রীর মা-মাসি-বোনেরা, মামা-ভাইয়েরা) থাকতে তাদের কাছে না গিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার চাওয়াটাকেও আরেকটা অপরাধ (উক্ত ব্যক্তিবর্গকে অমান্য করা বা এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত) হিসাবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ গারো সমাজের অপরাধ ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাই হচ্ছে- জনমত। এই জনমতের ভিত্তিতেই যে কোন অপরাধ বিশ্লেষণ, অপরাধীর বিচার, তিরস্কার, সংশোধনের প্রক্রিয়া, আর্থিক জরিমানার পরিমান নিরূপণ ইত্যাদি চুড়ান্ত হয়ে থাকে। গারোদের বিচার ব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- অপরাধ যেই করে থাকুক, অপরাধের দায়ভার তার মানকের বা গোষ্ঠীর বলে মনে করা হয় এবং আর্থিক জরিমানা প্রদান করার দায়িত্বটাও পড়ে মানকদের উপর। সুতরাং একজনের অপরাধ এবং শাস্তি তার মানকদের (গোষ্ঠী) উপরে বর্তানোর ফলে সকলেই সকলকে যেকোন অপরাধ থেকে দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর। গারোদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, সামাজিকভাবে শালিস বৈঠকের মাধ্যমে সমাধানের পর কোন কলহ বিবাদ জিইয়ে রাখে না এবং প্রতিহিংসামূলক বা ক্রোধবশত প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে না। কারণ, গারোদের প্রতিটি বিচার সালিশের পর বিচারকমণ্ডলীদের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়- ‘আজকের বিচারের পর বাদী বিবাদী কোন পক্ষই আর এবিষয়ে (অপরাধ ও বিচার সম্পর্কে) কোন কথা বলতে পারবে না, যদি কেউ বলে সেটিকেও অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে; একারণে তাকে/তাদেরকে দ্বিতীয়বার বিচার ও জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে’। ফলে পরবর্তীতে বাদী-বিবাদী এবং সমাজের সর্বস্তরে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার জন্যে তারা আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকে; আর এক্ষেত্রে বিরাট অবদান গারোদের প্রচলিত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় শিষ্টাচার এবং অপরাধ ও বিচার ব্যবস্থার কৌশল। এগুলো মেনে চলায় গারোদের সহনশীল ও সম্প্রীতিমূলক আচরণ অনেকের কাছে বা ভিন্ন জাতির কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু এটিই হচ্ছে গারো সমাজের বর্তমান বাস্তবতা এবং গারো জাতির মূল্যবোধের অনন্য উদাহারণ।

গারোদের অতীত বিচার ব্যবস্থা এবং প্রেক্ষাপট যদি আরেকটু ঘেটে দেখি, জাতিগতভাবেই গারোরা সৃষ্টিকর্তা এবং ধর্মের উপর ভীষণভাবে আস্থাশীল। অন্যান্য জাতির ভেতরে যে হারে পাপকর্ম বা অন্যায় অবিচার হয়, ধর্মীয় ভীতির কারণেই গারো সমাজে তুলনামূলকভাবে তা কম হয়ে থাকে। তারপরও গারোরা শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে এবং পারিপার্শিক পরিবেশ থেকে দেখাদেখি অনেক অপরাধের তালিকা গারো সমাজেও প্রবেশ করেছে। তারপরোও গারোদের মধ্যে সরাসরি রাষ্টীয় আইনের দ্বারস্থ হয় না। গারোরা প্রথমে সামাজিকভাবে বিচার বা সংশোধনের প্রচেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে গারো সমাজের দর্শন হচ্ছে- সকলকে নিয়েই সমাজ; দুটো কলসী একসাথে রাখলে যেমন মাঝেমধ্যে টুকোটুকি লাগে- তেমনই সমাজে একসাথে বসবাস করলে ছোটখাটো ভুলত্রুটি মানুষের হতেই পারে। আর সকলের উচিত এই ভুলগুলোকে সংশোধন করে একতাবদ্ধ হয়ে বাস করা। গারো সমাজে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি দোষ স্বীকার না করলে যেসমস্ত প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দোষ-নির্দোষ নির্ণয় এবং বিচার সালিশ সম্পাদন করার প্রচলন আছে।

গারো সমাজের সাধারণ শিষ্টাচার, লোকাচার বা বিশ্বাসকে যদি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করি, গারোদের সামাজিক বিধানগুলো তাদের সমাজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত; যা অনেকটা জাতিগত, সামাজিক, পারিবারিক প্রথা হিসাবে আদিকালথেকে লালন ও পালন করে আসছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কেউ এগুলোকে অমান্য করলে গারোরা তাকে নির্লজ্জ, অবিবেচক এবং যথেষ্ট শিষ্টাচারের অভাব রয়েছে মনে করে। গারো প্রবীণ ব্যক্তিদের অভিমত, আমাদের সমাজে এমন কিছু কালচার বা প্রথা রয়েছে, যেগুলো গারোদের আইন নয় ঠিক, কিন্তু আইনের প্রায় কাছিকাছি; এবং এগুলো অমান্য করা ব্যক্তিরা ‘আসি_মালজা’,  ‘দাকমালজা’ বা খ্রা চাআত্তাগিপ্পা (যে ব্যক্তি অনৈতিক কর্মের মাধ্যমে অন্যদেরকে লজ্জায় ফেলে)- এর পর্যায়ে পড়ে। এসব শিষ্টাচার অমান্যকারীকে সামাজিকভাবে তিরস্কৃত হতে এবং অনেক সময় মৃদু শাস্তি বা জড়িমানার দায়ে পড়তে হতো।

 গারো সামাজিক অপরাধ বিশ্লেষণে দাকমালজা অন্যতম একটি। দাকমালজা-র অর্থ হচ্ছে ‘করা উচিত নয়- এমন কর্মকাণ্ডসমূহ’। দাকমালজার আওতায় পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা বা রীতিনীতি এবং রাষ্ট্রীয় আইনসমূহ। এই আইনগুলোর অমান্যকারীরা দেবতা প্রদত্ত শাস্তি ছাড়াও সামাজিক আইন এবং রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তি মাথা পেতে বাধ্য। দাকমালজার আওতাভুক্ত কর্মকাণ্ডসমূহের মধ্যে যেগুলো পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা বা রীতিনীতির মধ্যে পড়ে যেমন- ১) সমাজের ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডসমুহে লিপ্ত থাকা; ২) মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া; ৩) দোষ অস্বীকার করা; ৪) গিবত গাওয়া বা অপরের সমালোচনা করে মানহানি করা; ৫) নিজকর্মের দ্বারা অপরের সম্মানহানি করা; ৬) ব্যভিচার  বা পরকীয়ায় লিপ্ত হওয়া; ৭) ব্যভিচারের সন্দেহ বা অপবাদ দেওয়া; ৮) অসামাজিক বা অবৈধ কাজে প্রলোভন দেওয়া; ৯) জোরপূর্বক যৌনমিলনের চেষ্টা করা; ১০) অবৈধ যৌনমিলন করা বা মিলনে বাধ্য করা; ১১) অসৎ উদ্দেশে কারোর গৃহে প্রবেশ করা ইত্যাদি।

গারোদের সামাজিক অপরাধ বিধিবিধানে এসব অপরাধের চমৎকার বিচার ব্যবস্থা রয়েছে; এর মধ্যে ৯ এবং ১০ পয়েন্টে উল্লেখ আছে, যে কারোর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনমিলনের চেষ্টা বা অবৈধ যৌনমিলনে বাধ্য করা এটি মারাত্মক অপরাধ। যে কেউ এ ধরণের অপরাধটি করলে সামাজিকভাবে সমাধানের ব্যবস্থাও আছে। যার ফলে আদিকাল থেকে গারো সমাজে এ ধরণের অপরাধ করতে ভয় পেতো।

আজকের জামানায় সিনেমা, কিংবা  নাটকীয় কায়দায় গারো সমাজেও যে ধরণের খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং শুরু হয়েছে, আগামী প্রজন্মের আরও কি বিভৎস দিন অপেক্ষা করছে তা আল্লাহ মাবুদ ভালো জানেন। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দায় এক গারো নারীকে (২৭) ধর্ষণ করে স্বজাতি গারো পুরুষ। অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা হলো, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলো সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা হলো গারোদের প্রাচীন সামাজিক ব্যবস্থা, শিষ্টাচার ভুলে, ভুল পথে গিয়ে আজকের গারো প্রজন্মরা কোথায় যাচ্ছে এবং এরপর…..।