দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে অবশেষে আটকের ছ’দিন পর গতকাল (রোববার) সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম কারাফটকের অন্তরাল থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেন। ফিরলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় পরিবারে, বন্ধু স্বজন, এবং দেশের বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের কাছে। এটিই ছিল আপামর এবং সবার চাওয়া। বিশেষ করে যাঁরা বাক স্বাধীনতা, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করে, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা, রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়ন চায় তাঁদের-ই চাওয়া।

যদ্দুর জানতে পেরেছি মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মারফতে তিনি পেশাগত কাজে ১৭ মে সচিবালয়ে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী রোজিনাকে আটক করেন। সেদিন তিনি আর তাঁর স্বজনদের কাছে ফিরতে পারে নি। আটকের পর সেখানে শারীরিক-মানসিক অবমাননাকর নিগ্রহের পর তাঁর একটি রাত কাটাতে হয় শাহবাগ থানায়। সে রাতেই তাঁকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে তাঁর নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা দায়ের হয়। পরদিন তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। গতকাল রোববার পর্যন্ত রোজিনার কেটেছে কাশিমপুর কারাগারে। জামিনে মুক্ত হয়েও অসুস্থ হয়ে পড়া রোজিনা এখনো হাসপাতালে আছেন। ‍

তিনি কারামুক্ত হবার পর একদিকে স্বস্তি ফিরলেও পেশাগত সাংবাদিকতা, নিজের কাজে গণ্ডির কথা ভাবলে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, দেশে সত্যি-ই কী সাংবাদিকতা স্বাধীন? ধরে নিলাম দেশে সাংবাদিকতা স্বাধীন, তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় আসলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা দেশে কতটা স্বাধীন? স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধা যদি থাকে সেই প্রকৃত বাধাটা আসলে কোথায়?

দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় নি বলে সাংবাদিকতার কাজে গিয়ে আটক হওয়া রোজিনার জন্য দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমন কি জাতিসংঘও উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। এমন কর্মকাণ্ডে নিন্দা জানিয়েছে ও প্রতিবাদ করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন), পিইএন বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়াসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। খবর প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও তথ্যমাধ্যম।

জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর এই মামলাটি সম্পর্কে প্রথম আলোর পরিবার থেকে জানানো হয়  ‘রোজিনা ইসলাম জামিন পেয়েছেন, এই খবর আমাদের প্রাথমিক স্বস্তি দিয়েছে। তাঁর নামে দায়ের করা মামলাটি নিঃশর্তভাবে না তুলে নেওয়া পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি নিঃশঙ্ক ও নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। তাই বিষয়টির চূড়ান্ত সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকসহ সব মহলকে সজাগ থাকতে অনুরোধ করি।‘ এ ছাড়াও আরেকটা বিষয় স্পষ্ট নয়, মহামান্য আদালতের ধার্যকৃত পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকা সম্পর্কে হয়তো কারোর দ্বিমত নেই। তবে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে রোজিনার জামিন মঞ্জুর করা বিষয়টি দেশের বিভিন্ন সচেতন মহলকে জামিন হবার পরও ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করছে।

অনুসন্ধানী চোখে একজন সাংবাদিক জীবন বাজি রেখে খবর তুলে দেয় মিডিয়াতে। খবরটি যখন মিডিয়াতে তুলে দেয়া হয় সে খবর আমরা আয়েশভাবে পঠন বা শ্রবণ করি, কেউবা হা হুতাশ করে। ওসব সংবাদে কেউবা আবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। এমন সত্য ঘটনা বিবরণে, প্রকাশে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী আমলা, রাজনৈতিক কিছু মহল বিষাদে আক্রোশে ফেঁটে পড়ে। ফলে একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে, যে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি কিন্ত সেই স্বাধীন দেশে সংবাদ মাধ্যমে সে স্বাধীনতা কী আছে? সকল মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে? যদি না থাকে তাহলে গেল ৫০ বছরেও কেন এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি ! এর দায় ভার আসলে কার ?

সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া যদি না থাকতো তাহলে দুর্নীতিগ্রস্থদের জন্যে মহা সুবিধে হতো। সমাজের অন্তরালে ঘটনা, রাষ্ট্রের আনাচে কানাচে যে অনাচার, দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলো আল্লার ওয়াস্তে জায়েজ হয়ে যেতো। আমাদের বেমালুম ভুলে গেলে চলবে না- দেশ, রাষ্ট্র যতটুকু ভালো থাকে, ভালো আছে এই সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়ার অবদানে এটা আপনাকে আমাকে স্বীকার করতে-ই হবে।

সংবাদ মাধ্যম যেমন উন্মুক্ত হওয়া উচিত; তেমনি সাংবাদিক এবং ভিক্টিমকেও রেসপন্সসিভ হতে হবে। সংবাদ মাধ্যমকে মুক্ত গণমাধ্যম হিসেবে তৈরি করা উচিত এটি আপনার আমার সকলের দায়িত্ব।

লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী।