গারো তরুণ লেখক, বিশ্লেষক উন্নয়ন ডি. শিরা আজকের ফেবু স্ট্যাটাসে কাব্যিক বর্ণনায় যে ভাবধারার অবতারণা করেছেন তা বোধ করি স্থুল বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এমন কাব্যিক রস বুঝে উঠা অত সহজ ব্যাপার নয় বোধয়! না বুঝুক, কেউ না কেউতো বুঝবে নাকি ! কিংবা বোঝার চেষ্টা করবে। তাদেরকে সাধুবাদ জানাতে হবে। আপনি একজন কাব্যবোদ্ধা হয়ে থাকলে ওদেরকেই সাধুবাদ জানানো উচিত।
আজকাল মধুপুর ইস্যূ মানেই জগা খিচুড়ি পাকিয়ে চৌ রাস্তার মোড়ে ঠান্ডা মাথায় মদনের দোকানে গিয়ে গরম এক কাপ চা জন্মের সুখটানে খাওয়ার অবস্থা হয়। সাদা ভাত জেনেও ডালে চালে মিলিয়ে সহজাত খিচুড়ি অথবা নিজের মতোন করে খিচুড়ি বানিয়ে ফেলি। যেকোন কিছুকে জগা খিচুড়ি বানিয়ে ফেলা এটাই তাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আগে কখনো ছিল না। দেখিনি।
আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে সব বিষয়কে খিচুড়ি ভাববেন না। খিচুড়ির মতোন নয়। সব বিষয় জগা খিচুড়ি হতে পারে না। খিচুড়ি খাওয়ার অভ্যাস আপনার থাকতে পারে। তবে সবাই খিচুড়ি খেতে পছন্দ করে এমনটা ভাববেন না। আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত, কেউ কেউ কিন্তু সদা ভাত, আর নুন দিয়ে পান্তা ভাত খেতে ভালোবাসেন। পান্তা ভাত খেয়ে তিনি জীব জগতকে ভালোবাসেন। তার জীবদ্দশায় দেশ ও দশের জন্যে ভালো কিছু করেন।
একটি এলাকায় ঘটনার অন্তরালে অনেক জানা অজানা মুখ এবং মুখোশ লুকায়িত থাকে। যার ফলে এদের অস্পৃশ্য অস্তিত্ব দিনকে দিন দৃশ্যমাণ হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে মধুপুরে ইতিহাসে কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে।
তরুণ লেখক উন্নয়ন ডি. শিরা তিনি তার ফেবু স্ট্যাটাসে তারাপদ রায়ের একটি কবিতা ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’ শিরোনামের কবিতা দিয়ে এর নিগূঢ় অর্থ আলতোভাবে বোঝাতে চেয়েছেন।
কবিতার বক্তব্য বোঝার সুবিধার্থে রায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন টেনেছেন ঠিক এভাবে-
আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশে ধ্রুপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ
প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাইবাবু বললেন, ‘ঐটি বানরলাঠি গাছ।’
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিনমাস বকলস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খে’কিভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই কবিতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি, বিশেষত ঘুণে ধরা সমাজকে নতুন করে চিনতে বিশ্লেষণ করতে এই কবিতার শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। গতকাল পর্যন্ত আমরা যাকে বা যাদেরকে নিজেদের অত্যন্ত আপনজন মেনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছি, সম্মানের সাথে অতিথির আসনে বসিয়েছি, সমাদর করেছি— সেই তিনি বা তেনারা যখন সামষ্টিক স্বার্থের বাইরে গিয়ে কাজ করেন তখন আমরা সাধারণেরা বুঝতে পারি কোড়ালে কাঠ ব্যবহৃত হলেও কোড়াল গাছেদের একজন নয়। কোড়াল গাছেদের বন্ধু তো নয়ই বরং হন্তক। দেরিতে হলেও আমরা শত্রু—মিত্র চিনতে পারলাম। আরো চেনার আছে। চিনতে হলে প্রচুর পড়াশোনা মানসিক পরিশ্রম করা লাগে যা সর্বসাধারণের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। শত্রু—মিত্র অচেনা থাকার ফলেই কোড়ালেরা আমাদের সাথে মিশে বন্ধুর বেশে থাকে। মধুপর থেকে শুরু করে সর্বত্র কোড়ালদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
ঝড়াপাতার বন মধুপুরকে গারোরা হা.বিমা বলে আখ্যায়িত করেছে। হা. অর্থ মাটি বিমা অর্থ মা (স্ত্রী বাচক অর্থে ব্যবহৃত)। অর্থাৎ উর্বর মাটি। কৃষি ফসল থেকে শুরু করে বাগান-বাগিচার জন্য এই মাটি অত্যন্ত উপযোগী। এখানে অর্থকরী ফসল যেমন— আনারস, পেঁপে, কলা, হলুদের চাষ হয় ব্যাপকভাবে। মধুপুরে ১৯৪২ সালে ইদিলপুর গ্রামের জন ভেরোন রিছিলের হাত ধরে আনারসের চাষ হলেও বর্তমানে আদিবাসীদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ খুব অল্পই আছে। এখানকার বাজার অর্থনীতি রাজনীতি কবেই চলে গেছে অন্যদের নিয়ন্ত্রণে। নতুন করে দেখা দিয়েছে আন্তঃ দ্বন্ধ কোন্দল।
এডওয়ার্ড ইস্যুকে ঘিরে মধুপুরে আদিবাসীদের পক্ষে বিপক্ষের রাজনীতির উন্মোচন ঘটেছে। বিভাজন অনৈক্যের এই চর্চা মধুপুরবাসী তো বটেই গোটা গারো আদিবাসী সমাজের জন্যও এক অশনিসংকেত। সেটি আমলে নিয়েই এই লেখার সূত্রপাত।
এডওয়ার্ড মাংসাংকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের বিচার দাবি করে গতকালও টাঙ্গাইলে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে (নিউজ লিঙ্ক কমেন্টে)। এতে ভুক্তভোগী লিখিত বক্তব্যে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন। আমি বাদী বিবাদীর বক্তব্য অভিযোগে না গিয়ে কেবল এইটুকু বলবো— মাংসাং সাহেবের সাথে অরণখোলার চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম যা করেছেন সেটি স্পষ্ট অন্যায়। চরম অন্যায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। মাংসাং সাহেব যদি অন্যায় অপরাধ করে থাকেন তবে তাকে প্রচলিত আইনের আওতায় আনা যেতো; এভাবে গাছে বেঁধে প্রকাশ্যে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া একজন জনপ্রতিনিধির সাজে না। জনপ্রতিনিধিরা যদি এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া শুরু করেন তবে বিচার বিভাগের আর প্রয়োজন কী। যাঁরা সাংগঠনিক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে এই বর্বর কাজকে সমর্থন করছেন তাদের অবস্থান যথেষ্ঠ সন্দেহের। কারণ চেয়ারম্যানের পক্ষে স্ট্রং কোন যুক্তি দেখছি না। এঁড়ে যে কয়েকটা যুক্তি দেখনো হচ্ছে সেগুলো অত্যন্ত দুর্বল। নগ্ন নির্যাতনের জোয়ারে এসব অভিযোগ ভেসে যায়।
বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে গারোরা বসবাস করছে তারমধ্যে মধুপুর এমন এক বিপ্লবের ভূমি যেখানে গারোরা সংঘবদ্ধভাবে লড়াই সংগ্রাম করে টিকে আছে। এজন্য হা.বিমাবাসী বিপ্লবী অভিনন্দন পেতেই পারে। হা.বিমাবাসীর ধমনীতে এখনো সংগ্রামের রক্তধারা প্রবাহমান। এই ধারা আনয়ণে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ প্রশ্নাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সংগঠনটির সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতি অত্যন্ত বিতর্কিত। নিপীড়িত অধিকারহীন আদিবাসী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ষাটের দশকে সংগঠনটির গোড়াপত্তন করেছিলেন স্বর্গীয় পরেশ চন্দ্র মৃ। তিনি গারো রাজা নামে পরিচিত। জীবনভর তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। তার নিজ হাতে গড়া সংগঠনটির এমন হাল দেখে তিনি নিশ্চয়ই ব্যথিত মর্মাহত হয়ে থাকবেন।
মাংরুদামে বনবিভাগের নির্মাণ স্থাপনাকাল থেকেই জয়েনশাহীর সভাপতি ইউজিন নকরেক, উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান যষ্টিনা নকরেক ও তাদের অনুসারী নেতৃবৃন্দের প্রতি ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দের এক ধরণের এলার্জি অবিশ্বাস ফারাক তৈরী হয়েছে। জেষ্ঠ্য এইসব নেতৃত্বকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘কোদাল মারা কমিটি’ হিসেবে। যা বিপদ বাড়িয়েছে। আদিবাসীদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করতে বনবিভাগ যে ফাঁদ পেতেছিল সেই ফাঁদে পা দেয়া ঠিক হয়নি। যাঁরা ফাঁদে পা দিয়েছে তাদেরকে বিরোধপক্ষ বানানোটাও বিপত্তি বাড়ার কারণ। এখন গোটা হা.বিমার কথা মাথায় রেখে জেষ্ঠ্য নেতৃবৃন্দের উচিত হবে— নিজ জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা চিন্তা করা, নির্মোহভাবে আদিবাসী মানুষের পাশে থাকা। এখনো সময় ফুরিয়ে যায় নি।
হা.বিমায় আরো দক্ষ যোগ্য জেষ্ঠ্য নেতৃত্ব আছে। সংকটকালীন এই মুহূর্তে প্রয়োজনে তাদেরকে সামনে আনা যেতে পারে। তপ্ত হা.বিমাকে তারা বটবৃক্ষের মতো আগলে দিতে পারে শীতল ছায়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখনো তারা পরদেশী ক্ষতিকারক বৃক্ষ ইউক্যালিপটাস হয়ে যায় নি। ইউক্যালিপটাসগুলোকে সম্মুখ সমরের শত্রু না বানিয়ে বটবৃক্ষদের দিয়ে স্মার্টলি হ্যান্ডেল করানো যেতে পারে। ঘরে বিভীষণ থাকলে দেব-দেবতার আশীর্বাদপুষ্ট শক্তিশালী রাবণও পরাজিত হতে বাধ্য— এ কথা যেন ভুলে না যাই। হা.বিমার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখলাম।
উন্নয়ন ডি. শিরা (শিক্ষার্থী),
দর্শন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।