আজকাল জন্মদিন মানেই বিরাট মজা-টজার ব্যাপার। সঙ্গে ঘরোয়া কিংবা প্রতিবেশীকে নিয়ে ধুমধামের ব্যাপার-সেপারতো থাকেই। তবে আমাদের কাছে জন্মদিন ব্যাপারটা বরাবরই বেশ আলাদা। কেউবা এই স্পেশাল দিনে প্রিয়জনকে উইস না জানাতে পারলে ঐ দিনটি অসম্পূর্ণ লাগে। আবার কেউবা এই বিশেষ দিনটিতে বন্ধু বান্ধবী থেকে শুরু করে নিজের খুব প্রিয় কাছের মানুষটিকে সবার আগে স্পেশাল কিছু লিখে বা স্ট্যাটাস দিয়ে তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করি, তার আনন্দে আমরাও সামিল হই। সোস্যাল মিডিয়া, ফেসবুক ইত্যাদি তোলপাড় করি সেগুলো না হয় উহ্য থাক।
আমাদের ছোট্ট রাজ কন্যাকে নিয়ে ছড়া লিখেছি, তাকে নিয়ে গল্প লেখাও ব্যাপার ছিল না। ঘটা করে লেখাও যেতো। শুধু গল্প কেন, মহা গল্প হয়ে যেতো। মুখে অ-আ বলতে পারার পর থেকে যেসব পাকনা বুড়ির মতোন কথা শুনিয়েছে, অদ্যাবধি শুনাচ্ছে সে আবার মহা গল্প না হয়ে পারে! সেকেলে বাবা হিসেবে অবাক হতে হয়। মাঝে মধ্যে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আমার। বলতেই হবে তোমরা এ যুগের কত ভাগ্যবান সন্তান। তোমরা তো অতি আধুনিক। ৪জি ৫জিকে নেটওয়ার্কও তোমাদের কাছে হার মানে।
বিয়ের পর জন্মদিন পালন সেটিও বেমালুম ভুলে গেছি। আমি আর একা নই। এখন আমরা হয়ে গেছি। ছেলে মেয়ের জন্মদিন পালনও ক্যালেন্ডার পর্যন্তই আটকানো থাকে। মোদ্দা কথা, আমাদের ঘরে কারোর জন্মদিনে প্রতিবেশীদের দাওয়াত করা হয় না। বাড়ীতে যথারীতি থাকে ঘরোয়া প্রার্থনা আর সামান্য স্পেশাল খাবার। অতিরিক্ত আয়োজনও থাকে না। জন্মদিনে প্রতিবেশিকে দাওয়াত-ফাওয়াত সেতো আপনাদের বড় লোকদের রেওয়াজ। আবার কেউবা করে প্রতিযোগিতা, লোক দেখানো, বিলাসি আয়োজন এসব আর কি। এসব মনোভাব আমাদের ছিল না, ভবিষ্যতেও নয়। আমরা সেটাকে বিলাসিতা মনে করি। আমাদের প্রত্যেকের জন্মদিনে পারলে একবেলা উপোস রেখে সারাবেলা প্রভুর কাছে জপমালা করা সেও ভালো মনে হয়।
যদ্দুর মনে পড়ে, তখন মা ঐশিকার বয়স চার বা পাঁচ হবে। তো একদিন আমাদের সে রাজ কন্যার হলো কি- তো একদিন ডাইনিং টেবিলে কথা হচ্ছিল তার বড় দিদি ডেলা এবং সুবল এর বিয়ে নিয়ে। বিয়েতে অনেক মজাটজা হয়েছে, করেছি.. ইত্যাদি। তখন ঐশিকা হঠাৎ খাবার থামিয়ে বলে কি- ডেলা দিদির সাজুগুজু সব ভালো ছিলো, কিন্ত…,কিন্ত আবার কি ছিলো, মা বলো দেখি শুনি আমরা….। আমতা আমতা করে বলে… কিন্ত দু’জনের গলায় বালিশ মালাটা (মালার নিচের অংশে ত্রিভূজাকৃতির হৃদয় চিহ্ন) আমার একদমই পছন্দ হয় নি। ওটা দেখতে ঠিক বালিশের মতোন। এমন কথা শুনে সবার মুখ ফসকে হাসি বেড়িয়ে এলো। ভাবুনতো এতটুকু বাচ্ছা মেয়ে বিয়েতে বালিশ সাইজের মালা, সুন্দর অসুন্দর কিইবা বুঝে! নাটকীয়ভাবে হঠাৎ হাসির রাজ্যে আমরা। হাসি আর থামছে না। তখন কথা প্রসঙ্গে তার মা বলে, আরে মা আমরাওতো আমাদের বিয়ের সময় ওরকম বালিশ মালাটাই গলে পড়েছিলাম। ওটাকে প্রেম মালা বলে মা। মামনি বলছে, ও তাই। হুম মা। ঠিক তার একটু পরে আরেকটি প্রশ্ন করে, আচ্ছা মা তুমি আর বাবা যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমি কোথায় ছিলাম? আমাকে তোমরা কেন দাওয়াত করোনি? হ্যায় ঈশ্বর, টুকটুকি পিচ্ছি মেয়েটি বলে কি! প্রশ্নটি শুনে তার পাশে বসে থাকা বড় বোন কৃপা হাসতে হাসতে খাবার চেয়ার থেকে মেঝেতে পরে যাচ্ছিল। রীতিমতো খাবার টেবিলে আবার হাসির ধুম পড়ে গেল। সেদিন হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গিয়েছিলো। আমরা সবাই হাসছিলাম তা ঠিক, কিন্ত আমি তার দিকে একটু খেয়াল করলাম কথাগুলো সে সিরিয়াসলি বলেছে। নিজে না বুঝে হাসছে কিন্ত মুখখানা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। দেখুন তো এমন অদ্ভত প্রশ্ন আমাদের অনেকেরই মাথায় আসে না। আমরাও হয় নি। মনেটনেও পড়ে না। শেষে প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতেই হলো। আর আমি বললাম, আরে মামণি তুমি তো তখনো ঈশ্বরের কাছে। তখনো তোমাকে আমাদের কাছে ঈশ্বর পাঠায় নি। ও তাই নাকি বাবা ! হুম তাই মা…। অল্প উত্তর কিন্ত টনিকের মতোন কাজ হলো। যাক মামণির কাছে এবারের মতোন বাঁচলাম। এখানেই পান্ডিত্যের গল্প শেষ নয়, বন্ধুরা আরও আছে…।
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ীর সবাই আমরা প্যারিসের বাইরে বেড়াতে গিয়েছি। শহুরে যানজট কোলাহল থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশে বেড়ানোর এমন মজা কেনা চায়! সিনা টান করে দুহাত তুলে বুক ভরে নি:শ্বাস নিতে কি যে প্রশান্তি এটা শহুরে মানুষগুলো ভালো বুঝে। আমার ছোট্ট মেয়েটির আবার বারবেকিউ (barbecue) ভীষণ পছন্দ। ভাবলাম এবার তাহলে টু মেরে ফ্রান্সের দক্ষিণে পিকারদিতে ঘুরে আসা যাক। অনেক দিন যাওয়া-টাওয়া হয় নি। তো আর ভনিতা নয়। যেমন কথা তেমন কাজ। দ্রুতগামী ইউগো ট্রেনের টিকিট করে মেনকা হাগিদক দিদির বাড়ীতে সোজা উঠলাম। আয়োজনটাও টিপটপ ছিলো সঙ্গে বারবেকিউ (barbecue), উফ্ কি মজা! পরদিন সন্ধ্যায় কয়লায় বারবেকিউ। বিষয়টি ভাবতেই ছোট বেলায় পহাড়ি পাখী মেরে কয়লার আগুনে পুড়ে খাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়। বারবেকিউর মেন্যু ছিলো ফরাসী বাহারী সসেজ আর চিকেন। ঘরের বাইরে এবং সব্জি বাগানের কাছে খোলা জায়গায় বারবেকিউ চলছে। আমিও টুকটাক দিদিকে হেল্প করছি। আমরা সবাই ওখানে। বারবেকিউর ধোঁয়ায় পুরো এলাকা গন্ধে মৌ মৌ করছিল। মাংস আর সসেজ আগুনে ছ্যাকার কাজ শেষ। এবার সোজা খাবার পালা। খাবার টেবিলে চলে গেলাম। বারবেকিওর সঙ্গে সেদিন যুক্ত হয়েছিলো আরও কিছু ফরাসী খাবার। আমাদের খাবার দাবার প্রায় শেষ। খাবার শেষে ডেসার্ট খেতে খেতে মেনকা দি কৃপা এবং ঐশিকার উদ্দেশ্যে উপদেশ দিচ্ছিল। আমরাও পাশে বসে কথাগুলো শুনছিলাম। বয়োজ্যেষ্ঠদের উপদেশ সাধারনত যেমন হয়। তিনি বলছিলেন, তোমাদের জন্য মা বাবা দুজনে অনেক কষ্ট করছে, কষ্ট এখনো করছে তোমাদের মানুষ করার জন্য এবং বড় করে তুলছে তোমাদের…ইত্যাদি। মেনকাদি’র কথাটি শেষ করতেই ঐশিকা বলে উঠলো, না আজং (মেনকা হাগিদক) আমাকে মা বাবা বড় করে নি, ঈশ্বরই আমাকে বড় করেছে…..। তার (ঐশিকা) কথা হলো, তোমরা আমাকে বড় করো নি, ঈশ্বর নিজে আমাকে বড় করেছে। এমন ঐশরিক, আধ্যাত্মিক উত্তর শুনে হাসির ধুম পরে গেল। মেয়েটির বয়স হবে আর কত হবে ছয়, তবে পুরো সাত নয়। এতটুকু বাচ্ছার অমন উত্তর শুনে সবাই যেন থ হয়ে গেল। আবার মুখ চেপে হাসিটাও ধরে রাখতে পারছিলাম না।
এমন অনেক আশ্চর্যজনক কথাবার্তা আমাদের মনে পড়ে। খুব ছোট বেলা থেকেই পান্ডিত্যের ভাষায় কথা বলে। যাকে আমরা বলি পাকনা বুড়ি। প্রতিবেশীরাও এর স্বাক্ষী। তার মতোন বয়সে আমরা সেরকম ছিলাম না। এমন পান্ডিত্যে কথা বলাতো দুরের কথা। কোনভাবে মাথায় আসে নি কখনো আমাদের। যা হোক ঐশিকার কোন এক জন্মদিনে লেখা ছড়াটি পুনরায় ছাপালাম এবং আমার নিজের লিখা ছড়া-
ঐশী
ঐশী মোদের ছোট্ট খুকি, ভারী মিষ্টি তার নাম
সারাবেলা অ-আ শিখে, শিখে কত ছড়া গান
কথার ছলে বায়না ধরে, কিনে দিতে হবে পুতুল
পুতুল না হলে খেলবে না সে, ঝরবে কত মুকুল।
সকাল সন্ধ্যা খেলায় মগ্ন, গাঁথে কত ফুলের মালা
পুতুল খেলায় সবযে ভুলে, জুড়ায় মনের জ্বালা
দাদির কথা শুনে না খুকি, তাইতো দাদীর রাগ
যতই করা ছলাকলা, দাদীর কোলেই ফাগুন মাঘ।
দাদীর কোলেই ঘুমায় খুকি, দাদীর হাতে ভাত
ঢোলের তালে নাচে খুকি, সকাল বিকাল রাত
বাবার ফোনে একই প্রশ্ন, কবে আসবে তুমি?
দেখবে আমায় নয়ন ভারে, দেখবে জন্মভূমি।
(কাব্যগ্রন্থ: অতৃপ্ত কিছু বাক্য)
আজ সে মামণি ঐশিকার ১১তম জন্ম দিন। আমাদের প্রিয়তমা কন্যাকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছাসহ ভালোবাসা! তুমি আমাদের কাছে অবিশ্বাস্যরূপে মূল্যবান এবং আমরা আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো যে তোমরা আমাদের সবকিছু। তোমার জন্মদিনটি জাঁকজমকের চেয়ে ভালো কাজে, মানুষের ভালবাসা এবং কল্যাণে পূর্ণ হোক। জীবনে আমরা তোমার কাছে অনেক কিছুই চাই; তোমাদের সাফল্য, সুস্বাস্থ্য এবং জীবনে সুন্দর ভাগ্য গড়ে তোল।
শুচ্ছোন্তে,
মা, বাবা ও বড় বোন কৃপা সাংমা।