আমরা কিউআর কী, কোডের ব্যবহার, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় জানার আগে, আসুন নিশ্চিত হয়ে নিই যে কিউআর কোড কী তা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া যাক। কিউআর কোড এমন একটি কোড যা একটি ক্যামেরাযুক্ত এন্ড্রয়েড সেল ফোন , ট্যাবলেট অথবা আপনার কম্পিউটার ডিভাইস দ্বারা দ্রুত পঠনযোগ্য কোড। এখানে এক ধরণের ম্যাট্রিক্স বারকোড (এ ২-ডি বারকোড) সংখ্যাগুলোর সংমিশ্রণে ব্যবহার করে থাকে। যখন কোন কিউআর কোড স্ক্যান করা হয়, তখন সেখান থেকে তথ্য সরবরাহ করে। যুগের বিবর্তনে কিউআর কোডগুলির খুচরা, বিপণন পণ্যসহ লজিস্টিকের মতো সব ধরণের শিল্প জুড়ে এর বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে।

অনেক প্রযুক্তি বিকাশের মতোন কিউআর কোডগুলিরও বিকাশের স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে। শুরুর দিকে কিউআর কোডগুলি প্রয়োজনীয়তার বাইরে তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ কিউআর কোডগুলি আসলে বারকোড হিসাবে তাদের সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র সুপার মার্কেটের পণ্যগুলোর জন্য। ১৯৬০ সালে জাপান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি ইঙ্গিক অনুভব করছিল। সুপারমার্কেটগুলিতে যেমন খাবার আইটেম বিক্রয় থেকে শুরু করে পোশাক এবং অন্যান্য পণ্যগুলির বহুমুখী প্রসার পরিসীমা যোগ করতে চেয়েছিল। সুতরাং, তারা মূলত বুঝতে পেরেছিল যে সমস্ত কিছুর উপর নজর রাখার জন্য তাদের একটি বিশেষ উপায় প্রয়োজন।

বারকোড সৃষ্টির আগে, ক্যাশিয়াররা ম্যানুয়ালি প্রত্যেক আইটেমগুলি ধরে ধরে কোড তৈরি করে কোডগুলো প্রবেশ করে কাজ করতো, বিষয়টি আপনি কী কল্পনা করতে পারেন! অবশ্যই এ কাজটি করতে যুগের পর যুগে সময় লেগেছিল। কাজেই  সুপারমার্কেট পরিচালকরা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাদের জন্য এটির একটি টেকসই  সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

বারকোড এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গেলে কিউআর বারকোড কিভাবে  আবিষ্কার হয়েছিল সে বিষয়ইবা বাদ যাবে কেন? দ্য পয়েন্ট অফ সেল (পিওএস) সিস্টেম। সুপারমার্কেট ক্যাশিয়ারগুলির উপর ভার হ্রাস করার জন্য প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলস্বরূপ, একটি পিওএস সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল। এটি মূলত একটি বারকোডের নবজাতকের শিশুর মতোন নিবন্ধন করা যা কম্পিউটার দ্বারা স্বতন্ত্র আইটেমগুলির স্ক্যান করার অনুমতি দেয়। এই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এটি এখনও পর্যাপ্ত ছিল না। সুপারমার্কেটগুলি তখন অন্য প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিল, বারকোডগুলি কেবলমাত্র প্রায় ২০টি বর্ণমালার তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে এবং একটি মাত্রা (কোডিংয়ের এক দিক) দিয়ে কাজ করতে পারে)।

একটি কিউআর কোডের কাঠামো-  বর্তমান সময়ের কিউআর কোডটি ৭টি অংশ নিয়ে গঠিত। এই অংশগুলির প্রত্যেকটি এক ধরণের পিক্সেল প্যাটার্ন তৈরি করে যা ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার অনুরূপ থাকে। প্রতিটি উপাদানটির একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে যা কোডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করে যেমন মুদ্রণ দিকনির্দেশ, সময়, ত্রুটি সহনশীলতা এবং খালি স্থানগুলি কোডকে ঘিরে থাকা থেকে আলাদা করার জন্য।

বর্তমান সময়ের বিভিন্ন প্রকার কিউআর কোড  

বিভিন্ন প্রকারের কিউআর রয়েছে। কোড তৈরির উদ্দেশ্য ও ব্যবহার উভয় ক্ষেত্রেই অনেক নানা কারণও রয়েছে। এখানে কয়েকটি জনপ্রিয়  কিউআর কোড যেমন, ‍ক) মাইক্রো কিউআর কোড, খ) আইকিউআর কোড, এবং গ) ফ্রাম কিউআর কোড ইত্যাদি।

কিউআর কোডগুলি কীভাবে কাজ করে?                     

কিউআর কোডগুলি কীভাবে স্ক্যান করবেন- আজকাল বেশিরভাগ কিউআর কোডগুলি একটি স্মার্টফোন দিয়ে স্ক্যান করা হয়। অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস উভয় ডিভাইসের জন্য (ক্যামেরাসহ) কিউআর স্ক্যান করার জন্য অনেকগুলি এ্যাপস বা অ্যাপ্লিকেশন রয়েছে।  আপনি কেবল অ্যাপটি খুলে এবং এটি একটি বোতামের স্পর্শের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিউআর কোডটি স্ক্যান করে থাকে।

বিভিন্ন ইতিহাসে কথিত আছে, এক সময় রাজা-বাদশাহরা বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে গুপ্ত সংকেত ব্যবহার করতেন। রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সিজার গোপন লেখনীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পথ বেছে নিয়েছিলেন। ইংরেজি বর্ণমালাকে তিন ঘর পিছিয়ে লিখতেন তিনি। ব্যাপারটা খুব সহজ ও মজার। ধরা যাক, ইংরেজিতে APPLE লিখতে হবে। জুলিয়াস সিজারের সূত্র অনুযায়ী, অক্ষরগুলো তিন ঘর পিছিয়ে দিলে শব্দটি XMMIB হবে। এই তিন ঘর পেছানোর মতো সূত্রগুলোকেই গুপ্ত সংকেতের ‘কি’ বা ‘চাবি’ বলা হয়। যাঁর উদ্দেশে বার্তা লেখা হবে শুধু তিনিই জানবেন এই গোপন সূত্র। কোনো যুগেই গুপ্ত সংকেতের ব্যবহার থেমে ছিল না।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগ গুপ্ত সংকেত বা ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহার ছাড়া প্রায় অচল। কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, পাসওয়ার্ড, ব্যাংকে অর্থ লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ, এটিএম কার্ড, পণ্যের বারকোড বা কিউআর কোড ইত্যাদিতে ক্রিপ্টোগ্রাফি প্রয়োগ করা হয়। সংশ্লিষ্ট তথ্য গোপনীয় লেখনীতে রূপান্তর করাকে বলে এনক্রিপশন। যার সাহায্যে এই কাজটি করা হয় তাঁকে বলে ‘কিফার’। বর্তমানে বহুল কিফার হচ্ছে ‘ডিইএস’ বা ডাটা এনক্রিপশন স্ট্যান্ডার্ড। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি অক্ষরকে ৬৪ বিট আয়তনের একটি চারকোনা বাক্সে  রূপান্তর করা হয়। একটি পণ্যের নাম, পরিচিতি এবং অন্যান্য তথ্য এই পদ্ধতিতে রূপান্তর করলে একটি খাঁজকাটা চৌকো বাক্সের মতো দেখায়। এটা বর্তমানে ‘কিউআর কোড’ হিসেবে পরিচিত।

এছাড়াও কোডের ব্যবহার যেমন, ডিইএস বা ডাটা এনক্রিপশন স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহূত হয় ব্যংকের এটিএম কার্ডে। গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নম্বরকে এনক্রিপশনের মাধ্যমে গোপন ডিইএস নম্বরে রূপান্তর করা হয়। এ নম্বরকে ডিক্রিপশন বা পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে আবার একটি নম্বরে রূপান্তর করা হয়, যাকে বলে পিন নম্বর। এই ন্যাচারাল বা আসল পিন নম্বর গ্রাহক পান না। ন্যাচারাল পিন নম্বরকে এনক্রিপশনের মাধ্যম আরেকটি পিন নম্বরে রূপান্তর করা হয়, যেটাকে অফসেট পিন বলে। এই অফসেট পিন আবার এনক্রিপশনের মাধ্যমে কাস্টমার পিনে  রূপান্তর করা হয়। অর্থাৎ ধরা যাক ন্যাচারাল পিন হলো ০১২৩। এই কাস্টমার পিন নম্বরটি ব্যবহার করেই গ্রাহক এটিএম কার্ডের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করবেন। গ্রাহক তাঁর পিন নম্বর পরিবর্তন করলেও ব্যাংকের আসল পিন নম্বরে কোনো পরিবর্তন হবে না।

মোদ্দা কথা, কিউআর কোড ব্যবহার দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়ন ক্রিপ্টোলজি বা গোপন লেখনীর ব্যবহারকে বৈচিত্র্যময় করে তুলছে।

লুই সাংমা, প্যারিস, ফ্রান্স

ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী