মধুপুর শালবনের গারো নেতা পরেশ চন্দ্র মৃ’র ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। গারো নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর পরিবার পরেশ চন্দ্র মৃ’কে পারিবারিকভাবে এবং এলাকাবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। তাঁর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের আয়োজনে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মি. ইউজিন নকরেক। আরও উপস্থিত ছিলেন মি. অজয় এ মৃ (সহ সভাপতি বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম)।

তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ সহ এলাকার  বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। আবিমার গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ বার্ধক্যজনিত কারনে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ৭ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।

পরেশ চন্দ্র মৃকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

গারো নেতা পরেশ চন্দ্র মৃ’র সমাধিতে বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চুনিয়া গ্রামে পিতা রায়চান নকরেক এবং মাতা দেঙা মৃ’র কোলে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মধুপুরের সকল আদিবাসীদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের চেতনাকে জাগ্রত করে তোলার ক্ষেত্রে এবং এলাকার আদিবাসীদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গারোদের সংস্কৃতি পরিমন্ডলে তাঁর সীমাহীন অবদানের এলাকাবাসী এই কিংবদন্তি মহাপুরুষ পরেশ চন্দ্র মৃ’কে আবিমানি ‘গারো রাজা’ সম্মান দিয়ে থাকেন।

পরেশ চন্দ্র মৃ ভালুকা থানাধীন নলুয়াকুরি গ্রামে বঙ্ক চিসিম ও কুমুদিনি দারুর মেয়ে শিশিলিয়া দারুর সাথে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন; তিনি দুই পুত্র ও তিন কন্যার জনক। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন পরোপকারী, সুদুরপ্রসারী দৃঢ় মনোবল, পরিকল্পনাকারী, সুসংগঠক এবং প্রবল ইচ্ছা শক্তির অধিকারী। তিনি নিজে অনুভব করেছিলেন সুশিক্ষিত হয়ে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে, এ জাতির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য সকলকে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে সর্বদা উৎসাহিত করতেন। সে কারনে তিনি এলাকার আদিবাসীদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নয়নের পদ্ধতিগুলো নিয়ে ভাবতেন।

দেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বেঁধেছিল, তখন অনান্য হিন্দু পরিবারের মতো বঙ্কিমবাবুর পরিবারও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কলকাতায় চলে যাবার সময় পরেশ চন্দ্র মৃকেও সাথে নিয়ে যান এবং স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরেশ চন্দ্র মৃ ১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতার নারিকেল ডাঙ্গা হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। স্কুল জীবনে হিন্দু পরিবারে থাকার সুবাদে একাধারে যেমন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ রামায়ন, মহাভারত, গীতা ও বেদান্তর দর্শন পড়াশুনা করেছেন, তেমনই মাওসেতুং , মেসিম গোর্কি, এঞ্জেলস ও হিটলার লেলিনবাদ ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ পড়তেন। কলকাতায় বঙ্কিম বাবুর পরিবারে থাকার সময়ই তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সে বাড়ীতে অনেক বড় বড় রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ও সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে পরেশ চন্দ্র মৃ নিজেও নিজ আদিবাসী সামাজের দুরাবস্থার কথা ভাবতেন। তিনি ভাবতেন সমাজের কুশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এ সমাজকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতা থেকে নিজ গ্রামে ফিরে এসে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা আবিমা অঞ্চলের আদিবাসী সমাজে শিক্ষার আলো প্রজ্জ্বলিত করতে এলাকাবাসীর সহায়তায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পীরগাছা সেন্ট পৌলস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

পরেশ চন্দ্র মৃ’র আদর্শে যোগ্য একনিষ্ঠ অনুসারী, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমান উপদেষ্টা আদিবাসী নেতা মি. অজয় মৃ তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে একাধিকবার পরেশ চন্দ্র মৃ সম্পর্কে লিখেছেন এবং বিভিন্ন আলোচনা ও সভাসমূহে বক্তব্য বলেন, মহান নেতা পরেশ চন্দ্র যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করতেন এবং আমাদেরকেও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে গেছেন। তৎকালীন ১৯১২ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্য়ন্ত সিএসসি রেকর্ড করা আদিবাসীদের পত্তনী জমিগুলো নটিফিকেশান করে খাস ঘোষণা করে ও বনবিভাগের আওতায় নিয়ে; এবং পাকিস্তান শাসনামলেও (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে) জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার আদিবাসীদের একমাত্র আয়ের উৎস ঝুমচাষ বন্ধ করে দিয়েছিল। মুধুপুরের আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে ভূমির ন্যায্য অধিকারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন পরেশ চন্দ্র মৃ। পুনরায় ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার মধুপুরের আদিবাসী অধ্যুসিত গ্রামের বনাঞ্চলগুলো ধনী ব্যবসায়ীদের নিলামে বিক্রি করে দিয়ে পুনরায় সেখানে এবং আদিবাসীদের বাগান, আবাদি জমিতেও গাজারী ও শাল বাগান শুরু করলে আবারও পরেশ চন্দ্র মৃ জনগণের পাশে থেকে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছেন, প্রত্যক্ষভাবে প্রতিবাদ করেছেন। আদিবাসী নেতাদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্য়ায়ে আলোচনায় মৌখিক ও লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর ফলে আদিবাসীদের আবাসভূমি এবং আবাদি জমি সামায়িকভাবে রক্ষা পায়।

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার ‘এলাকার ৪০ বর্গ মাইল (১৫টি গ্রাম) নিয়ে জাতীয় উদ্যান করা হবে এবং সমস্ত আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদ করা হবে’- মর্মে ঘোষণা হলে আবারও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মধুপুরের আদিবাসীরা পরেশ মৃ’র নেতৃত্বে সরকারের কাছে প্রতিবাদ লিপি প্রদান করেন। পুনরায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে শুধু চুনিয়া গ্রামের (পরেশ চন্দ্র মৃ’র গ্রাম) আদিবাসী পরিবার উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়। পরেশ বাবুর নেতৃতে আদিবাসীদের প্রতিবাদ জোড়ালো হওয়ায় তারা এই নেতাকে পার্কের নির্ধারিত এলাকার বাইরে বা টাঙ্গাইল শহরে রাজকীয় বাড়ী অথবা ক্ষতিপূরণবাবদ তাঁর যা চাহিদা পূরণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্ত পরেশ মৃ জাতির অস্থিত্বকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এমন প্রস্তাব নাকচ করে জনগণকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি তখনই ঘোষণা দেন, ‘এই গ্রাম এবং এই বন ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না। আমরা বনের সন্তান, বন ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না’। এছাড়াও ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান গর্ভণর মোনায়েম খাঁনের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে পুনর্বাসনের ঘোষণা; ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল পার্কের নামে আদিবাসী অধ্যূসিত গ্রামগুলি কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে উচ্ছেদ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নোটিশজারী করা হয়েছিল। এভাবে বারবার আদিবাসীদের উপর সরকারের এবং স্থানীয় বাঙ্গালিদের অন্যায় উৎপীড়ণ থেকে রক্ষা, আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফাদার উয়াং এর পরামর্শ ও সহযোগিতা করতে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পরেশ চন্দ্র মৃ ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন শুরু করেন।

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কলমাকান্দা, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর ও শ্রীবর্দী থানার গারো, হাজং, ডালু, বানাই, হদি ও অন্যান্য আদিবাসীরা সীমান্তবর্তী রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার নির্য়াতন নিপীড়ন এবং গ্রামে চুরি, ডাকাতি, লুটপাত, খুন, নারী নির্য়াতন ইত্যাদি দেখে অতিষ্ঠ হয়ে, ভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসামে পালিয়ে যায়। তখনও পরেশ চন্দ্র মৃ সংনকমা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আবিমা অঞ্চলে জনগণকে সাহস যুগিয়েছেন এবং এলাকাকে সুরক্ষা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরেশ চন্দ্র মৃ আদিবাসীদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য এবং চাঁদা তুলে টাকা পয়সা দিয়েছেন। এ বিষয়ে কর্পোস খ্রীষ্টি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষিকা এবং জাইপ মহিলা বিষয় সম্পাদিকা এবং উপজেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম সদসয় মহিলা সভানেত্রী) পিউ ফিলোমিনা ম্রং পরেশ চন্ত্র মৃত্যুর পরবর্তী এক সম্মরণ সভায় বলেছেন, আওয়ামীলীগার হিসেবে পরেশ চন্দ্র মৃ ই হলেন মধুপুর জেলার প্রথম ব্যক্তি। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নিয়ে মধুপুরের টাঙ্গাইল দোখলা রেস্ট হাউজে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য আসেন। সে সময় পরেশ চন্দ্র মৃর তত্বাবধানে ও সহায়তায় বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজটি শুরু করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর মন্ত্রীপরিষদকে নিয়ে পরেশ চন্দ্র মৃর বাড়ীতে বেড়াতে যান। সেখানে আদিবাসীদের সুখ দু :খ নিয়ে আলোচনা করেন। সে আলোচনায় পরেশ চন্দ্র মৃর নেতৃত্বে বিচক্ষনতা, কৌশল এবং সফলতা দেখে, আবিমার আদিবাসীদের জন্য তার তাকে বঙ্গবন্ধু মধুপুরের গারো রাজা বলে সম্বোধন করেন। তারপরও সে বছরই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মুজিব সরকার আদিবাসী গ্রাম উচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে জিয়ার শাসন আমলেও সামারিক আইন অনুযায়ী আবার উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সব ক্ষেত্রেই দৃঢ় মনোবলের অধিকারী বাবু পরেশ চন্দ্র মৃ এলাকার লোকজনদের সংগঠিত করে সরকারের কাছে বাঁচার দাবী নামে এক ঐতিহাসিক লিখিত দাবী পেশ করেন।

বিভিন্ন সভা সমাবেশে আদিবাসী নেতৃবৃন্দরা প্রায়ই বক্তব্যে বলেন, পরেশ চন্দ্র মৃ’র বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, নিঃসার্থ মানবসেবা, উন্নয়নকল্পে সংগ্রামী জীবন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মাতৃভূমি আদিবাসী গ্রামকে রক্ষার চেতনা আজোও আবিমাঞ্চলের আদিবাসীদের অনুপ্রাণিত করে। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা সামাজিক অন্যায়-অবিচার, গারোদের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্দোলন ও প্রতিবাদ করতে গিয়ে পীরেন স্নালদের জীবন উৎসর্গ দিতে হয়েছে। এর সাক্ষ্য হয়ে উৎপল নকরেক পঙ্গুত্বকে বরণ এবং আরও অনেকেই বুলেটবিদ্ধ হয়ে করে আজও বেঁচে আছেন। (তথ্যসূত্র: গারো সংস্কৃতির মাধুর্য)