বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশী গারোদের মধ্যে ৯৮% ভাগ এবং ভারতের ৮০% খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী। বাকী গারোরা আদিধর্ম সাংসারেক এবং হিন্দুধর্মানুসারি। বাংলাদেশে অল্প কিছু সংখ্যক গারো পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাঙালি সমাজের মতোই জীবনযাপন করছে। গারো সমাজের আদি বিবাহ জিকগিদ্দি রা.আ, চাপ্পা পদ্ধতি নিয়ে বর্তমান গারো জেনারেশানদের খটকা লাগতেও পারে। তেমনি বিভিন্ন বাঙালী সামাজে, লেখকের লেখনী, কিংবা মিডিয়াতে প্রচারিত গারোদের বিবাহ পদ্ধতি সম্পর্কিত কিছু তথ্য আমাদের বর্তমান গারো প্রজন্মদের বিভ্রান্ত, বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
বিয়ের আইনগত প্রচলিত প্রথা ছাড়াও গারো সমাজে এমন কতগুলো বিয়ের প্রথা প্রচলিত রয়েছে যেগুলো সাধারণভাবে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশী গারোদের মধ্যে ৯৮% ভাগ খ্রিষ্টান হওয়ায় আদি পদ্ধতিতে বিয়ে হয় না। কদাচিৎ ঘটে থাকলে, তাহলে উক্ত দম্পতিদের পুনরায় খ্রিষ্টধর্মমতে বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়। গারোদের আদি বিবাহ দুটি পদ্ধতির মূল পার্থক্য সংক্ষেপে আলোচনা করা গেল-
জিকগিদ্দি রা.আ– শাব্দিক অর্থ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ। স্ত্রী যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের কথা ভেবে চ্রাগণ অর্থাৎ মামা, ভাইদের দল সেই পুরুষ/স্বামীর জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়ার অনুমতি দেন। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে বাধ্য বাধ্য করা হয়। এছাড়াও স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগলে বা দুর্ঘটনাজনিত কারণে পঙ্গুত্ব এবং স্ত্রীর মৃত্যুবরণ করলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে হয়। তবে যে কারণেই দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়া হোক না কেন, দ্বিতীয় স্ত্রীটি প্রথম স্ত্রীর গোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন। যেমন, স্ত্রী যদি চিরান হয়, তাহলে দ্বিতীয় স্ত্রীও হতে হবে চিরান মা.চং পরিবারের। এভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়াকেই জিকগিদ্দি রা.আ বলা হয়।
চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা– চাপ্পা, অনচাপা বা দকচাপার বাংলা অর্থ হচ্ছে একটার সাথে আরেকটা দিয়ে দেওয়া। উপযুক্ত কোন পুরুষ বা মহিলা বিধবা অথবা বিপত্নীক হয়ে থাকবে- এটা গারো সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু, অপমানজনক। কারোর স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে সে সামাজিক (আখিম) আইনের মাধ্যমেই স্বামী/স্ত্রী দাবী করতে পারে। যদি পুরুষ/স্বামী মারা যান, তাহলে স্বামীর আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্বামীর পরিবর্তে স্বামী দিতে না পারে। স্ত্রী মারা গেলেও একইভাবে আত্মীয়স্বজনেরাও অপমানিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, যদি স্ত্রীর পরিবর্তে স্ত্রী দিতে না পারে। তাই মধ্য বয়সে কারোর স্বামী মারা গেলে আর উপযুক্ত বা সমবয়সের পুরুষ পাওয়া না গেলে এবং ঐ মধ্য বয়স্কার জন্য দ্বিতীয় স্বামী হিসাবে তরুণ-যুবককে দিতে হয়। এমতাবস্থায় এই তরুণ স্বামীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কম বয়সী মেয়েকে স্ত্রী হিসাবে নির্বাচন বা দেওয়া হয়- এই পদ্ধতিটাকেই চাপ্পা/অনচাপা/দকচাপা বলা হয়।
গারোদের প্রথাগত বিবাহ পদ্ধতি অলিখিত হলেও সামাজিকভাবে স্বীকৃত, এবং আইনের মতোই শ্রদ্ধা করে। গারোদের প্রথাগত প্রাচীন এ সকল বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য বর্তমান গারো প্রজন্মদের বিভ্রান্ত, বিব্রতকর অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেবে। তথ্যসূত্র: গারো সংস্কৃতির মাধুর্য (প্রকাশিতব্য)
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ওয়েভ ডেভেলপার, ব্লগার, আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সার এবং
সাংস্কৃতিক কর্মী, lchiran76@gmail.com