কোনও মেয়ে বেশ্যা হয় না, পুরুষেরা তাদের বেশ্যা বানায়। তাই সভ্য মানুষেরা এই মেয়েদের ‘প্রস্টিটিউট’ বলে না, বলে ‘প্রস্টিটিউটেড উইমেন” ।
জনপ্রিয় সাহিত্যক এবং নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন এর বেশ্যা শব্দটির ব্যাখ্যা যেকোন সাংস্কৃতিকমনা এবং প্রগতিশীল চিন্তকের মনে ধরবে। তাঁর চিন্তা শক্তির প্রখরতা, লেখনী আমাদের ঝিমানো সমাজ, সমাজ ব্যবস্থাকে, চেতনায় ভাঁজ পড়া মনুষ্যত্ব নাড়িয়ে দেয়। যেমনটি তিনি এক ফেবু স্ট্যাটাসে আজ লিখেছেন।
তিনি সেখানে লিখেছেন, দরিদ্র নিপীড়িত মেয়ে, পুরুষ দ্বারা প্রতারিত হয়ে সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, নানা জাতের নানা বয়সের নানা মেজাজের অচেনা অজানা পুরুষদের কাছে দেহ বিক্রি করে দু’পয়সা রোজগার করতে যারা বাধ্য হয়, তাদেরই বেশ্যা বলা হয়।
কোনও মেয়ে বেশ্যা হয় না, পুরুষেরা তাদের বেশ্যা বানায়। তাই সভ্য মানুষেরা এই মেয়েদের ‘প্রস্টিটিউট’ বলে না, বলে ‘প্রস্টিটিউটেড উইমেন’।
এই সংজ্ঞাটি শোনার পর এক পাল নারীপুরুষ খেঁকিয়ে উঠে বলবে কলেজ ছাত্রীরা বাড়তি টাকার জন্য দেহ বিক্রি করে। আমি জানি সে কথা, কিন্তু সংজ্ঞাটি লক্ষ কোটি মেয়ের কথা ভেবে তৈরি করা, তুলনায় অতি সামান্য মেয়ের কথা ভেবে নয়।
বাংলাদেশের পুরুষেরা আশির দশক থেকে লক্ষ্য করেছি, এই সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে মেয়েদের বেশ্যা বলে। আমি যখন পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে লেখা শুরু করেছি, আমাকে পাল পাল পুরুষেরা ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিয়েছে। শুধু ধর্মান্ধ অশিক্ষিত মৌলবাদিরা নয়। শিক্ষিত শ্রেণী যাদের বলি, তারাও। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি দেহ ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করতাম? না, আমি ছিলাম ঢাকা শহরের স্বনামধন্য দুটো মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল — মিটফোর্ড এবং পরে ঢাকা মেডিক্যালের সম্মানিত ডাক্তার। আমি ছিলাম জনপ্রিয় সাহিত্যিক। আমার কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ছিল বেস্ট সেলার লিস্টে। প্রকাশকেরা আমাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অগ্রীম রয়্যালটি দিত। আমি যদি মেয়ে না হয়ে পুরুষ হতাম, তাহলে বেশ্যা বলে গালি দেওয়া পুরুষেরা আমাকে নমো নমো করতো। তসবিহ হাতে নিয়ে যেমন আল্লাহ নাম জপে, তেমন জপতো আমার নাম।
বেশ্যার সংজ্ঞায় না পড়লেও আমাকে বেশ্যা বলে কেন ডাকা হয়েছে অথবা আজও কেন হয়? আমি যে পুরুষদের সঙ্গে শুয়েছি, তাদের কাছ থেকে কি কানাকড়ি নিয়েছি? না, বরং তাদের পেছনে আমার যথেষ্ট টাকা খরচ হয়েছে। তাহলে ওই পুরুষদের বেশ্যা বলে না ডেকে আমাকে কেন ডাকা হয়? ডাকা হয় কারণ আমি আমার বইগুলোতে সত্য কথা বলেছি, কাউকে তোয়াক্কা না করে বলেছি, কারণ আমি সত্যবাদী এবং সাহসী। আমার এই সততা, সাহস এবং আত্মসম্মানবোধ তাদের সহ্য হয় না বলে বেশ্যা বলে গালি দেয়।
বাংলাদেশে বেশ্যা বলে যে মেয়েদের না ডাকা হয়, তাদের সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণা নেই। বেশ্যা বলা হলে আমি বুঝে যাই এই মেয়েগুলো নষ্ট পচা সমাজে সাহসী স্বনির্ভর আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলা মেয়ে। যাদের ভালো মেয়ে বলে ডাকা হয়, তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা, এরা পচা পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, এরাও প্রগতির বিরুদ্ধে, এদের মস্তিস্কে কিছু নেই, এদের চরিত্র বলেও কিছু নেই।