ঠিক মনে পড়ছে না— এ বছরের শুরুতে, না, গত বছরের শেষ দিকে আলাপ হয়েছিল। বলেছিল শুধু হা.বিমা না, হা.পালেও এ সমস্যা হতে পারে। অস্তিত্বের সংকট দরোজার সামনে এসে কড়া নাড়তে পারে।
বলতে বলতে এও বলছিলেন, একবার কি একটা কাজে তিনি ঢাকায় গিয়েছেন। সরকারি এক কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছেন। তখনই জানতে পারেন একটা মহল হা.পাল এলাকার বর্ডার এরিয়ায় যত ফরেস্ট ও পাহাড়ি ভূমি রয়েছে বছরে বিরাট অংকের রাজস্ব আয় দেখিয়ে সেই ফরেস্ট ও পাহাড়ি ভূমি সরকার থেকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার জোর তৎপরতা করছে। সেই কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনাদের এলাকায় এরকম ভূমি কি পরিমাণ আছে বলে মনে হয়? জবাবে তিনি বলেন, হাজার হাজার একর তো আছেই। কিন্তু এসব ভূমিতো এমনি এমনি পড়ে নেই। সিংহভাগ ভূমিতেই মানুষ বসবাস করে। ইজারা দিলে, প্রকল্প করলে, এদের কী হবে? এদেরকে কি সরে যেতে হবে? কর্মকর্তা বলেন, সেরকম হলে তো সরে যেতেই হবে। উন্নয়নের জন্য কিছু তো ছাড় দিতেই হবে। তাছাড়া উন্নয়নের ফলতো সেখানকার অধিবাসীরাই ভোগ করবে।
বলেন, গজনী অবকাশ কেন্দ্র, লাউচাপড়া পিকনিক স্পট, গাবরাখালি পর্যটন কেন্দ্র এগুলো কি উন্নয়ন? সরে যেতে হলে তো মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। মানুষ তার অস্তিত্ব হারাবে। ভূমিহীন গৃহহীন বাস্তুছাড়া হবে। হয়তো মধুপুর গড় থেকেও হা.পালের অধিবাসীদের সংকট প্রবল ও প্রকট হয়ে দেখা দেবে।
প্রকৃতপক্ষে এসব মহলের ইজারা নেওয়া ও প্রকল্পের পেছনেতো বিরাট অংকের রাজস্ব আয় বা উন্নয়ন করা না, প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ভূমি কুক্ষিগত করা। ভূমি নিজেদের করে নেওয়া। বাণিজ্যিকভাবে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করা। আর এসব কাজে যত না সরকারের, বনবিভাগের আগ্রহ ও প্ল্যান আছে তার চেয়ে মহল বিশেষের, তার চেয়ে গ্রুপ অব কোম্পানীজদের, তার চেয়ে ভূমি দস্যুদের আগ্রহ আছে। কেবল চালাকি করে উন্নয়নের বুলি আওড়িয়ে, ঢাল হিসেবে সরকারকে সামনে রেখে, বন বিভাগকে সামনে রেখে কোন না কোন উপায়ে জমিটা নিজেদের করে নেওয়া।
মানুষ একবার ভূমি হারালে সে তার সবকিছুই হারায়। বেঁচে থাকার শক্তি হারায়। সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় চেতনায় বিকশিত হবার সুযোগ হারায়। তার আর বিকাশ ঘটে না। সে সংকুচিত হয়ে পড়ে। আর অবিকশিত, সংকুচিত ও অস্তিত্বহীন মানুষ বিপদ দেখলেই ভয় পায়। ভয়ে পালায়। তার আর লড়াই করা হয়ে ওঠে না।
উন্নয়নের নামে বা অন্য কোন উসিলায় ভূমি দখল নিতে এরা এমন কোন হীন কাজ করতে দ্বিধা করবে না যার কারণে প্রকৃত ভূমিপুত্ররা ভূমি হারিয়ে পরবাসী হয়ে পড়ে, উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।
দুই.
এই আলাপেরও কয়েক মাস বাদে এক বড় ভাই জিজ্ঞেস করতেছিলেন, হালুয়াঘাটের গাবরাখালি না কোথায় যেন আমাদের মন্ত্রীর নামে সরকারীভাবে একশ বিঘা না একশ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া আছে, তুমি জানো কিনা? মন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী সেই ভূমিতে নাকি ভূমিহীন গরীব গারোদের জন্য ঘর তৈরি করে দেবে, বাসস্থানের সুযোগ করে দেবে। বললাম, এটা শুনিনি বা জানি না। তবে হা.পাল এলাকায় যত পাহাড়ি ফরেস্ট ভূমি আছে পর্যায়ক্রমে সেসব ভূমি দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে শুনতে পাই। আর সম্প্রতি গাবরাখালিতে পিকনিক স্পট বা পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর সমালোচনা হচ্ছে। এলাকাবাসী এ ধরণের পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণকে তাদের জীবন-জীবিকা ও স্বাভাবিক বেঁচে থাকার অধিকার পরিপন্থী ও অশনি সংকেত হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। গারোরা কি শেষ পর্যন্ত চিরিয়াখানায় প্রদর্শীত জীব, এ প্রশ্ন তোলা হচ্ছে?
ভেতরে ভেতরে হা.পাল এলাকার পাহাড়ি ফরেস্ট ভূমি দখল প্রক্রিয়া শুরু হয়ে থাকলে এবং এসব ভূমি হতে বসবাসরত মানুষদের কেদিয়ে, তাড়িয়ে, উচ্ছেদ করে প্রকল্প বাস্তবায়নেরও কৌশলও থাকবে। এই বরাদ্দকৃত ভূমি সেই কৌশল কিনা, প্রকল্পের অংশ কিনা সজাগ থাকতে হবে। আর যার নামে এসব করা তিনি তো আর বেঁচে নেই।
তিন.
অধুনা ১২ আগস্ট ২০২১ শ্রীবর্দীর বালিজুড়িতে গারো জনগোষ্ঠীর পাঁচটি পরিবারের আবাদি জমি ও ভিটেবাড়িতে রোপনকৃত বিভিন্ন ফলজ উদ্ভিদ ও মৌসুমি সবজির বাগান কেটে বিনষ্ট করে সেখানকার বিট ফরেস্টাররা হুমকি দিয়ে গেছে বাসস্থান গুটিয়ে তারা যেন অন্যত্র চলে যায়। এটা বন বিভাগের জমি। মুল্লুকটা শুধু যেন বন বিভাগেরই। বাসস্থান নির্মাণ করে, বাড়ির আশপাশে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষদের উৎখাত করা বাংলাদেশের কোন আইনে আছে বা বন সংরক্ষণ আইনে আছে এরকম আমার জানা নাই। বরং বাসস্থান থেকে উৎখাত করা বাংলাদেশ আইন পরিপন্থী ও অপরাধ। আর গ্রাম বাংলায়তো একটা কথা চালু আছেই ‘স্বয়ং সরকার বা সরকার প্রধানও ভিটেবাড়ি থেকে কাউকে উৎখাত করতে পারে না। তার এ এখতিয়ার নাই।‘ তদুপরি এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ও এভাবে হুমকি দিয়ে বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তারা কি বার্তা দিতে চায়? তাদের এ দস্যুতার, এ দুর্বৃত্তায়নের এজেন্ডা কী? পাঁচটি গারো পরিবারকে তাদের জমি থেকে, ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাত করে, বিতাড়িত করে, উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়ে তারা কি পেতে চায়? তাদের এ সাহসের রহস্য কি?
এ জাতীয় হুমকি ও উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সুস্পষ্টত অপরাধ। যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আর এ ধরনের হুমকি ও দুর্বৃত্তায়নের মুখে আমরাও নত হব না। আমরা নিজেদের ভূমি কোন অবস্থাতেই খোয়াতে চায় না। মনে রাখতে হবে, জমি খোয়ানো মানে নিজেদের সবকিছুই খোয়ানো।
কার্তিক ঘাগ্রা
লেখক ও প্রকাশক।