জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো আপনার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়া। জীবনে চলতে ফিরতে গিয়ে এই সঠিক সিদ্ধান্তটি আমরা অনেকেই নিতে পারি না। ফলে আপনার চলার পথ সোজা কিংবা আঁকা-বাঁকাও হতে পারে। বাস্তবতায় যা দেখা যায় এ স্তর থেকেই কর্মসংস্থানের বাস্তব প্রেক্ষাপট ও পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে অনেকে তার গন্তব্য বা যাত্রাপথ বদলে ফেলে। অথবা ভালো পাশ করলে তাকে সরকারী চাকরী নির্ভরতা পেয়ে বসে।
কমবেশি আমরা সবাই জানছি, আগামীর পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও পরিবর্তনমুখী। তবে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে এই পরিবর্তন যে এত দ্রুত হবে, তা একেবারেই অনুমেয় ছিল না। এত দিন যে পৃথিবী বা প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে পেশাজীবনের পরিকল্পনা করেছে, মাত্র দু-তিন মাসের ব্যবধানে সেটা আমূল বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে। আর এই পরিকল্পনায় আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতাকে এবং জরুরী গুরুত্ব দেয়া উচিত।
সামনের দিনগুলোতে আমাদের প্রযু্ক্তি নির্ভরতা বাড়বে আরও। তাই প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কারিগরি জ্ঞান, ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতা শিক্ষার্থীদেসহ যেকোন পেশাজীবিকে এগিয়ে রাখবে।
দ্রুত পেশাজীবনে প্রবেশ করতে চাইলে তারা সামনে পা বাড়ানোর আগে শিক্ষার পাশাপাশি ফ্রীল্যান্সিং এর কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সবাই হয়তো কারিগরি, সাধারণ শিক্ষায় পড়াশোনা করবে না বা টপ সাবজেক্টগুলো নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ পাবে না। কিংবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষাক্ষেত্রেই পড়বে। তবে যারা সাধারণ শিক্ষায় ভবিষ্যৎ শিক্ষা পরিকল্পনা করছে, তাদেরও নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতা অর্জন করতে হবে সামনের পৃথিবীতে নিজের অবস্থান টেকসই করার জন্য।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের ফলে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে; যেমন অনলাইন ক্লাস, ক্লাউড বেজড লার্নিং, অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তি এবং পরীক্ষা, হোম বা ভার্চ্যুয়াল অফিস, অনলাইন মিটিং, লাইভ স্ট্রিমিং, অনলাইন সাক্ষাৎকার, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং, রোবটিকস, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ব্লকচেইন, বিগ-ডেটা ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সামনের দিনে সব কর্মপরিকল্পনা পরিচালিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা প্রায় নিশ্চিত করছেন। ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরও বাড়বে এবং পরিবর্তিত ও উন্নত হবে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তারাই এগিয়ে থাকবে, যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত বা এই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত।
যারা শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতা অর্জন করবে তাদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করা অধিকতর সহজ হবে। এখনো এমনও কাউকে কাউকে দেখা যাবে, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফ্রীল্যান্সিং কাজ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই বা এখনো শুরুই হয়নি। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে হয়তো এখনো আবিষ্কৃার করতে পারেনি। যে বা যারা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেকে আপডেট করতে পারে তখন নিজেক আধুনিক এবং কার্যকর মনে হবে, আর তা না হলে হয়তো নিজেকে অনেক বছরের পুরোনো ও গতিহীন মনে হবে।
দেশে বিদেশে প্রযুক্তিনির্ভর কাজের সংখ্যা বেড়েছে অনেক, তবে সে তুলনায় প্রযুক্তিনির্ভর কর্মীর সংখ্যা খুব কম। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর তরুণদের নাম লেখাতে হচ্ছে শিক্ষিত বেকারের তালিকায়। অধিকাংশ অভিভাবকের ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে টেকসই সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতেই হবে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের পৃথিবীতে ফ্রীল্যান্সিং দক্ষতাই বড় ভূমিকা রাখবে।
একজন ফ্রিল্যান্সারের যেরকম রয়েছে কাজের ধরণ নির্ধারণের স্বাধীনতা, তেমনি রয়েছে যখন ইচ্ছা তখন কাজ করার স্বাধীনতা। গতানুগতিক অফিস সময়ের মধ্যে ফ্রিল্যান্সার স্বীমাবদ্ধ নয়। কোম্পানিগুলো সাধারণত আউটসোর্সিং করে উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য। অনেক সময় পর্যাপ্ত সময়, শ্রম অথবা প্রযুক্তির অভাবেও আউটসোর্সিং করা হয়। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর কাজগুলো (যেমন- Web Development, Software Development, Software tester, Writing & Content, Multimedia & Architecture, SEO/SEM/SMM, Graphics design, Data Entry ইত্যাদি) আউটসোর্সিং করা হয়। যেসকল দেশ এই ধরনের সার্ভিস প্রদান করে থাকে তার মধ্যে ১০টি উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে আমেরিকা ৭৮%, ইংল্যান্ড ৫৯%, ব্রাজিল ৪৮%, পাকিস্তান ৪৭%, ইউক্রেন ৩৬%, ফিলিপিন ৩৫%, ইন্ডিয়া ২৯%, বাংলাদেশ ২৭%, রাশিয়া ২০%, সার্বিয়া ১৯% এবং আরো অনেক দেশ।
আপনাকে মনে রাখতে হবে, শুধু সচেতনতার অভাবে আমরা আমাদের আশপাশে থাকা সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে পারি না। পাস করে তারপর চাকরি বা ব্যবসার প্রস্তুতি নেব, এমন সময় সম্ভবত আমদের আর নেই। বিষয়টি আমাদের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের এই মুহূর্ত থেকে অনুধাবন করতে হবে।
সবশেষে একটি কথা নিশ্চিত করে বলতে চাই, যার ফ্রীল্যাসিং দক্ষতা আছে, তাকে বেকারত্ব স্পর্শ করতে পারে না।
লুই সাংমা, ফ্রান্স
ফ্রীল্যান্সার, ব্লগার এবং সাংস্কৃতিক কর্মী।