মানবিক হওয়া উচিত আদর-স্নেহ, ভালবাসা, শাসন আর বিবেকের হাত ধরে। এতটা মানবিক হওয়া উচিত না যতটা মানবিক হলে মানব জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আর যে মানবিকতায় মানব জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে তাকে মানবিকতা বলে না। তাকে বলে মানবহীনতা
আমরা দিনকে দিন অতি মাত্রায় মানবিক হয়ে যাচ্ছি। কথায় বলে না, অতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না ! হ্যাঁ কথাটা খুবই সত্যি এবং মারাত্মক সত্যি। তেমনি অতিরিক্ত মানবিক হয়ে গেলেও সমস্যা বাড়ে বৈকি!
এই যেমন ধরুন এক সময় গার্ডিয়ান শিক্ষককে বলতো, আমার বাচ্চাকে ধরে মেরে মানুষ করে দেন। ধরে মেরে মানুষ করে দেন মানে এই না যে শিক্ষক ছাত্রকে কামাড়ের মতোন পিটিয়ে পিটিয়ে মানুষ করবেন। এর মানে ছিল জ্ঞান অর্জনে যা যা করার দরকার সেটি যেন শিক্ষক নিজে থেকে করেন। অর্থাৎ পূর্ণ অধিকার অভিভাবক শিক্ষকে দিয়ে দিতেন। অবশ্য বাংলাদেশের মতোন দেশে এখনও শিক্ষক নামধারী খাস বা জাত কসাই আছেন। সে কথা আলদা। এখন নিয়ম হয়েছে বেত্রাঘাত করা যাবে না। আরও ত্রিশটা বছর পর বলা হবে বাচ্চা বয়সে অতিরিক্ত মাত্রায় সাবজেক্ট দিয়ে ব্রেইনে আঘাত দেওয়া যাবে না। এর ত্রিশটা বছর পর ১০ বছরের নিচে কোন শিশুকেই স্কুলে ভর্তি নেওয়া হবে না। কারণ দশ বছরের নিচে কাউকে জোড় করে জ্ঞান দিতে গেলেই মানুষ বলবে বিষয়টা অমানবিক। আরও ত্রিশটা বছর পর কাউকে আর জ্ঞান মাথায় রাখতে দেওয়া হবে না। তখন সব জ্ঞান থাকবে ইলেকট্রনিক বা প্রযুক্তি ডিভাইসে। যা দরকার সব পাবেন কম্পিউটার ঘেটে। তখন শুধু কম্পিউটার চালানো শেখানো হবে। অথবা মেমোরি চিপ বসিয়ে দেওয়া হবে ব্রেইনে। এইভাবে ত্রিশ ত্রিশ… করে বহু বছর পর মানুষেরা বলবে অমানবিক ভাবে হাটিয়ে হাটিয়ে কোথাও কাউকে পাঠানো যাবে না। বা হেটে বেড়ানো যাবে না। হুইল চেয়ারের আদলে কিংবা উড়ন্ত চেয়ারের আদলে চলাফেরায় বা স্থান পরিবর্তনে মানুষের জন্য নতুন প্রযুক্তি আসবে। এইভাবে মানুষ হাটতেও ভুলে যাবে । হাটার যেহেতু প্রয়োজন নেই সেহেতু পা মানুষের কাছে অতিরিক্ত অঙ্গ হিসেবে ধরা দেবে।
এরপর শুরু হবে জিন বিষয়ক গবেষণা। কীভাবে জন্মের সময় পা ছাড়া শিশু জন্ম দেওয়া যায় সেই গবেষণা। একদিন সফল হবে এতেও । তখন পা হীন পেতলা দুই হাত যুক্ত থলথলে আকারের মানুষ জন্ম নিতে থাকবে। এরপর আরও মানবিক চিন্তা ভাবনা শুরু হবে মানুষের। তখন আত্ম হত্যাকে আর অপরাধ হিসেবে ধরা হবে না। এই যেমন কিছুদিন আগে নিউজ পেপারে দেখলাম একটি দেশে আত্ম হত্যার মেশিনকে বৈধ্যতা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই ধাপেও কিন্তু আমরা এগিয়ে গেছি। আত্ম হত্যাও মানুষের অধিকার সেটি ফলাও করে প্রচার করা হবে। দেশে দেশে জেলখানা বন্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু জেলখানা বন্ধ হয়ে যাবে তখন মানুষ যাতে অপরাধ প্রবন না হয়ে উঠে সে জন্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জন্মের পর পরই তার মাথা থেকে রাগ ঘৃণা কিংবা ক্ষোভ সংক্রান্ত সকল ব্রেইন সেল ধ্বংস করে দেওয়া হবে। অনেকটা সকল ধরণের অনুভূতির মৃত্যু হবে মানুষের জন্মের পরই। জন্মের কিছুদিন পরই মানুষ সার্ভাইব করার জন্য প্রযুক্তির সকল জ্ঞান মাথায় ঢুকানো চিপের মাধ্যমে অনায়াসে রপ্ত করে নিবে। সারাদিন মানব জাতির কল্যাণ আর প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যস্ত থাকবে মানুষ। আর সেই মানুষকে তখন আর মানুষ বলা যাবে না। বলা যাবে যন্ত্র বা যান্ত্রিকতা।
অনুভূতিহীন মস্তিষ্ক, অর্ধ অঙ্গহীন তখনকার মানুষ অতি মানবিক হতে গিয়ে যান্ত্রিক হয়ে যাবে। আর আমরা হেটে চলেছি সেই যান্ত্রিক গোলক ধাঁধা পৃথিবীর দিকেই। অনেক সাইন্স ফিকশনিস্ট তাদের বিজ্ঞান কল্প কথায় ভবিষ্যতে যন্ত্রের কাছে মানব জাতির হেরে যাওয়ার গল্প লিখেছেন ঠিকই; কিন্তু অতি মানবিক ভাবনা থেকেই যে এর জন্ম হতে পারে, তারা সেটি অনুধাবন করতে পেরেছেন কিনা তা পরিষ্কার করে বলতে পারি না।
মানবিক হওয়া উচিত মানব সভ্যতার কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি না করে স্পষ্ট নিয়মনীতির আওতায় থেকে। মানবিক হওয়া উচিত আদর-স্নেহ, ভালবাসা, শাসন আর বিবেকের হাত ধরে। এতটা মানবিক হওয়া উচিত না যতটা মানবিক হলে মানব জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আর যে মানবিকতায় মানব জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে তাকে মানবিকতা বলে না। তাকে বলে মানবহীনতা।
লেখক – বাপন নেংমিঞ্জা