আমাদের সমস্যা আসলে পোষাকে না; আমাদের সমস্যা মনে। পোশাক কার ছোট সেটা বিষয় না বিষয় হলো আমাদের মন ছোট

সেই ছোট্টবেলা। মানে পাঁচ থেকে ছ’বছরের কথা বলছি। যখন স্কুলে প্রথম যাওয়া শুরু করি। স্কুলে প্রায়ই একটা জিনিস দেখে কোন মানেই বোঝা যেত না, সেটি হলো মেয়েরা দুই বেনী করে না আসলে তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। কেন দেওয়া হতো সেটা সেই বয়সে বোঝার সামর্থ্য হয়নি আমার। দুই বেনী মানে দুইটি ঝুটি বেধে স্কুলে আসতে হবে। চুল ছেড়ে আসা যাবে না। চুল অগোছালো করে আসা যাবে না। চুলে তেল দিতে হবে। এইসব। কিন্তু দুই বেনী করার সাথে স্কুলের কি সম্পর্ক সেটি আমার মাথায় ছিল না। এরপর প্রাইমারী ছেড়ে হাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম। এখানে আরেক নিয়ম। চুলতো দুই বেনী করতেই হবে সাথে আটসাট ওড়না নিয়ে স্কুলে আসতে হবে। আমি ছেলে । মেয়েদের কথা বলছি। ওড়না হলো এক গুচ্ছ কাপর যা জামা প্যান্টের বাইরে একটি অতিরিক্ত কাপর যেটা দিয়ে শরীর ঢাকা হয়। আমি দশ কি এগারো বছরের স্টুডেন্ট তখনও বুঝতে পারিনি এটির সাথে বিদ্যালয়ের সম্পর্ক কি। দেখতাম মাঝে মাঝেই স্কুলের ম্যাম, শিক্ষক এরা এইসব নিয়ে হরহামেশায় ঝামেলা করতেন। আর আমরা নাবালক ছেলেরা কিছুই বুঝিনি সমস্যা কোথায় । আর এখন বড় হয়ে বুঝতে পারছি আমাদের সমস্যা মাথায়, চিন্তায় আর ভাবনায়।

আমরা খ্রীস্টান ধর্মালম্বীরা আদম – হবার কাহিনি ছোট বেলাতেই শুনে বড় হই। তিনারা ইশ্বরের সৃষ্টির পর দুজনই উলঙ্গ ছিলেন। কিন্তু তিনারা উলঙ্গ শব্দের অর্থ জানতেন না। লজ্জা স্থান শব্দের মানে বুঝতেন না । নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর বুঝতে পারলে তাদের শরীরে এমন কয়েকটি অঙ্গ আছে যেটি ঢেকে রাখতে হবে। সেই ফল কিন্তু নিষিদ্ধ ছিল। আর নিষিদ্ধ ফল মানেই মানব সভ্যতার জন্য অভিশাপ । সেই অভিশাপ থেকেই আমরা নিজেদের উলঙ্গ অবস্থাকে জানতে শুরু করলাম তারপর ঢেকে রাখতে শুরু করলাম আমাদের নিজেদের লজ্জাস্থান। বিজ্ঞানের ভাষায় ঐ স্থানের নাম প্রজনন অঙ্গ। আর মানব সভ্যতার বিকাশে, বংশবৃদ্ধির জন্য এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাহলে এই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গকে ঢেকে রাখার দরকার কী হতে পারে? দরকার ছিল না। আমরা নিজেরা মানে মানুষেরাই এই নিয়ম বের করেছি। এখন হঠাৎ একজন মানুষ এসে যদি প্রচার করা শুরু করেন আমাদের কানও ঢেকে রাখতে হবে তাহলে বিশ বছর পর দেখবেন অন্যকে কান দেখাতেও আমাদের লজ্জা করবে। কানের জন্য আবিষ্কার হবে নতুন ধরণের বস্ত্র। আর বস্ত্র যখনই আবিষ্কার হয়েছিল সেদিনই আমাদের প্রথম সমস্যা শুরু হয়। সেটি হল বস্ত্রহীন আর বস্ত্র আবৃত মানুষের ব্যাবধান। এই বিষয়ে নতুন করে খুলে বলার আর দরকার বোধ করি না।

এবার আসি শহর আর গ্রামের কথায়। বিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র্য মানুষের কথায়। শহরের দুলালেরা কখনও গ্রামীন নারীদের জীবন দেখে না। তারা সিনেমায় দেখে। নাটকে দেখে। সিনেমা নাটকে অভিনয় করা হয়। সেই অভিনয়ে একজন গ্রামীন নারীর জীবন সংগ্রাম নিয়ে একটি গল্প থাকতে পারে। গল্পে নারীটির জন্য একজন কস্টিউম ডিজাইনার থাকে। ব্যাবসা সফল সিনেমা বানাতে পরিচালক কোন নারীর বস্ত্র সংক্ষিপ্ত না করে এমনভাবে সিনেমা বানান যাতে রক্ষনশীল আর ভক্ষনশীল দুটো সমাজের কাছেই ব্যাবসা সফল সিনেমা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা একবারেই ভিন্ন। একজন মাটি ভরতি খাচা উবানো নারীর ব্লাউজ ঠিক থাকে না। কোমড় অবধি নাভি দেখা যায়। স্তন বের হয়ে থাকে। কাজের চাপে তার মাথায় দিন শেষের তিনশো টাকা মাইনেটা হীরে টূকরোর ন্যায় জ্বল জ্বল করে। মাথায় দশ কেজি ওজনের চাপে তার শরীরের লজ্জা ঢাকার কথা মনে থাকে না। অথবা দিনে তিনশো টাকা কামানো সেই মহিলার বোরখা কেনার টাকা থাকে না মাসের শেষে। কোথায় তখন তো তাদের কেউ হেনস্তা করে না ! সহকর্মী হাজার পুরুষ তাদের সাথে কাজ করেন তারাতো সেই নারীর ইজ্জত নিয়ে কথা বলে না ! তাহলে পোষাক কেন আমাদের মাপকাঠির একটি ইউনিট হয়ে দাঁড়াবে?

আমাদের বাংলাদেশে এই মুহুর্তে দু ধরণের মানুষের বিচরণ । কেউ আপাদমস্তক নিজেকে ঢেকে রাখার যুক্তিতে রাজি। আবার কেউ পোষাকের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। এখন কথা হলো এই পর্যন্ত বাংলাদেশে কোথাও কোন রেকর্ড নেই যে বাংলাদেশের রাস্তায় কেউ বিকিনি পরে হেটেছে। অথবা কেউ সুইমিং ড্রেস পরে হেটেছে। কোন নারী স্লিভলেস জামা পড়েছে, কোন নারী জিন্স পড়েছে, কেউ ওড়না না দিয়ে গাউন পড়ে হেটেছে। এটা একেবারেই নরমাল কেস। এতটাই নরমাল যে ভাতের সাথে তরকারী মেখে খাওয়ার মত। কিন্তু কেউ কেউ এটাও মানতে নারাজ। কেন নারাজ সেটা এতদুর জানার দরকার নেই। যারা নারাজ তাদের ঘরে এখনও ডিস লাইন চলে। ভারতের বলিউডের গান চলে। পশ্চিমা সিনেমার লিপ কিসের সীন চলে । পশ্চিমা ক্যাটওয়াকের শো চলে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল প্রতিবেশী ভারতের আইটেম সঙ তাদের খুবই ফেবারিট। তারমানে টেলিভিশন পর্দায় এরা বিনোদন নেয় ঠিকই, অপরিচিত নারীদের স্লিভলেস জামা দেখে কটুক্তি করে ঠিকই কিন্তু নিজেদের পরিবারের সবাইকে দেখতে চায় পর্দায় মোড়ানো।

আমাদের সমস্যা আসলে পোষাকে না। আমাদের সমস্যা মনে। পোশাক কার ছোট সেটা বিষয় না বিষয় হল আমাদের মন ছোট। পুরুষরা পেশী ফাটানো হাফ হাটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরতে পারবে কিন্তু স্তন উচু দেখানো জামা পড়ে মেয়ে মানুষ ঘড় থেকে বেড় হলে পুরুষদের সেটা সহ্য হয়না। সহ্য হয়না এমন না। নতুন কোন মেয়ে ঐ পোশাক পড়ে সামনে এলে ঠিকই শিসের উছিলায় উলুধ্বনি দিবে কিন্তু ফেমিলির কেউ এইভাবে বেড় হলে গলা কেটে দিতে চায়বে । এটি একটি রোগ । এই রোগের নাম “ছাগল মাইন্ড” । যতদিন এই ছাগল মাইন্ড আমাদের মাঝে বিরাজ করবে ততদিন আমরা ধর্ষন করব। ততদিন আমরা জামা কাপড়ের মত সাধারণ বিষয় নিয়ে রাজু ভাস্কর্য্যের সামনে দাড়াবো। ততদিন আমরা এও মনে করব মেয়েদের কাপড়ই তাদের বিরম্বনার জন্য দায়ী। কারন আমরা ছোট মনা। ছোট মনা জীবনে পৃথিবীর সবকিছুকেই ছোট করে রাখতে চাইবো। বড় হবেনা ভাবনা। বড় হবেনা আমাদের মন ।